প্রকাশিত:
১২ জুন ২০২৫, ১২:০০
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বহুল আলোচিত অকাস সাবমেরিন চুক্তি নতুন করে পর্যালোচনা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, চুক্তিটি বর্তমান প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চীনকে প্রতিহত করার কৌশলের অংশ হিসেবে ২০২১ সালে স্বাক্ষরিত এই ত্রিপাক্ষিক নিরাপত্তা চুক্তির আওতায় অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে পারমাণবিকচালিত সাবমেরিন পাবে। পরবর্তীতে, তিন দেশ মিলে একটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন বহর তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাবেক প্রশাসনের নেওয়া এই উদ্যোগ বর্তমান প্রেসিডেন্টের কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তা যাচাই করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপে যুক্তরাজ্য প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৮ সালের মধ্যে জিডিপির ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সম্মত হয় এবং আগামী সংসদ মেয়াদে তা ৩ শতাংশ করতে চায়। তবে অস্ট্রেলিয়া এখনো ৩.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনাগ্রহী। এর মধ্যে চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্তে নতুন করে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড মার্লেস স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি এখনো আত্মবিশ্বাসী যে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার জন্য দূরপাল্লার সাবমেরিন ক্ষমতা অপরিহার্য।’
চুক্তি পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এলব্রিজ কোলবি নামে এক সাবেক কর্মকর্তাকে, যিনি অতীতে অকাস নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যখন এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন কেন তা অন্যদের দিয়ে দিচ্ছি?’
যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া বলছে, প্রশাসন পরিবর্তনের পরে এমন পর্যালোচনা স্বাভাবিক।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার জানিয়েছে, ‘এই ঐতিহাসিক প্রকল্পে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।’ যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘অকাস আমাদের দুই নিকটতম মিত্রের সঙ্গে এক যুগান্তকারী নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব। এটি ইন্দো-প্যাসিফিক ও ইউরো-আটলান্টিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ।’
চুক্তির আওতায় কী রয়েছে?
অস্ট্রেলিয়ার জন্য এই চুক্তিটি তাদের সামরিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের উন্নয়নের প্রতিনিধিত্ব করে। যুক্তরাজ্যের পর দেশটি ওয়াশিংটনের অভিজাত পারমাণবিক চালনা প্রযুক্তি গ্রহণকারী দ্বিতীয় দেশ হয়ে উঠেছে।
এই ধরনের সাবমেরিনগুলো দেশটির বিদ্যমান ডিজেল-ইঞ্জিন বহরের চেয়ে আরো দ্রুত এবং আরো বেশি গতিতে কাজ করতে সক্ষম হবে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া প্রথমবারের মতো শত্রুদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ পাল্লার আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে।
২০২৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কিছু পারমাণবিক সাবমেরিন অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে মোতায়েন করা হবে। ২০৩০ সালের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনটি পুরনো ভার্জিনিয়া-শ্রেণির সাবমেরিন কিনবে অস্ট্রেলিয়া, পরবর্তীতে আরো দুইটির অপশন রয়েছে। একদম নতুন একটি পারমাণবিকচালিত সাবমেরিন ডিজাইন ও তৈরি করা হবে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার জন্য — যা ব্রিটিশ ডিজাইনে হলেও প্রযুক্তি আসবে তিন দেশ থেকেই।
এদিকে চুক্তিটি নিয়ে চীন বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এটি অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি তৈরি করছে এবং অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক ‘ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ’-এর জেনিফার কাভানাঘ বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন নির্মাণ সামর্থ্য সীমিত এবং দেশের প্রয়োজন পূরণেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই এই চুক্তি পর্যালোচনা করা যৌক্তিক।
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা থাকতে পারে যে, অস্ট্রেলিয়া এই সাবমেরিনগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত উপায়ে ব্যবহার করবে কি না — বিশেষ করে যদি তাইওয়ান ইস্যুতে সংঘর্ষ শুরু হয়।
পর্যালোচনার ফলে চুক্তির অগ্রাধিকার সাবমেরিন সরবরাহ থেকে সরে গিয়ে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র প্রযুক্তি ভাগাভাগির দিকে যেতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই চুক্তি থেকে পিছিয়ে যায়, তাহলে তা চীনের জন্য বড় জয় হবে বলেও মন্তব্য করেন কাভানাঘ। চীন দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তির সমালোচনা করে আসছে।
অকাস চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের অবস্থান পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির এই উদ্যোগ এখন নতুন করে মূল্যায়নের মুখে পড়েছে — যা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
মন্তব্য করুন: