প্রকাশিত:
২৪ মে ২০২৫, ১৭:৫১
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত-
তার আগেই কবি নজরুল শুধু শান্ত নয় বরং অসহনীয় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ৩৪ বছরের নীরব নিথর জীবনকে মেনে নিয়েছেন। ১৮৯৯ সালে ১১ জ্যৈষ্ঠ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মা জাহেদা খাতুনের কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হন। তারুণ্যের প্রাবল্য আর চেতনায় মানবতার পূজারি নজরুল উনিশ শতকীয় নবজাগরণের সুবর্ণ সময়ের ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেন। শৈশব-কৈশোর পার করতে হয় বিশ শতকের হরেক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশের বিপরীত স্রোতে। উপনিবেশিক শাসনের চরম দুর্দমনীয় পালাক্রমে সমকালীন অঙ্গন বিক্ষুব্ধ, অচলায়তন এক ভৌগোলিক সীমারেখায় আবর্তিত।
পরিবেশ পরিস্থিতি কোনোভাবেই অনুকূলে তো ছিলই না। বরং পারিবারিক আঙিনাও ছিল আরও এক দুঃসহ বাতাবরণে। তার ওপর নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে বিদেশী শাসন শোষণের অনিবার্য এক বেসামাল আবহে। সেখানে বরাবরই জিইয়ে থাকতো উদ্দীপ্ত তারুণ্যের বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব। প্রথাসিদ্ধ সমাজের বিরূপ পরিস্থিতিতে নজরুল কখনো শান্ত থাকতে না পারাও উল্টো রথে অবগাহন। মানুষে মানুষে ফারাক, তারতম্যও কখনো সহ্য করতে পারেননি। উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি।
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
আশৈশব নজরুলের এই ছিল চিরায়ত আদর্শ, অবিচলিত দেশপ্রেম আর সব মানুষের প্রতি অনন্য দায়বদ্ধতা। সেখানে কখনো তাকে থামতে দেখা যায়নি। দুমড়ে, মুচড়ে সব কালো ছায়ার বিপরীতে যে সাম্যের বাণী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেটাই বিদ্রোহী সত্তার আজন্ম লালিত স্বপ্নের যথার্থ গন্তব্য। অদম্য চেতনায় সৃজন শক্তিকেও নিবেদন করেছেন তেমন অসাম্য-বৈষম্যকে চিরস্থায়ী নির্মূল করতে। সেটাই ছিল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের অন্তিম পর্ব। জীবনটা ছিল শুধু ছন্নছাড়াই নয় বরং অদম্য তাড়নায় ভেতরের উদ্দীপ্ত সৃজন শক্তির অবিস্মরণীয় মেলবন্ধন।
পড়শোনার ধারাবাহিক যাত্রায় ব্যবচ্ছেদের যে পালাক্রম সেটাও নিত্য জীবনের অন্যরকম ঝড়ো হাওয়া তো বটেই। পারিবারিক সম্পর্কে দৈন্যদশায় গৃহছাড়া হতেও সময় লাগেনি। পিতৃহীন দুখু মিয়ার (নজরুলের আর এক ডাক নাম) জন্মদাত্রী জাহেদা খাতুনের সঙ্গে স্নেহাতিশয্যের কোনো বন্ধনই ছিল না বলে সমকালীন অঙ্গনের বহু প্রবাদবাক্যে তা জানা যায়। দুঃখের তিমিরে অবগাহন করে যার জীবন তরী ভাসমান তিনিই একদিন উপনিবেশিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেবেন যেন এক অজানা বিস্ময়। তবে কিশোর নজরুলের মেধা ও মননের অভাবনীয় স্ফুরণ প্রকাশ হতেও খুব বেশি সময়ই লাগেনি।
এক প্রতিভাদীপ্ত শৌর্যের সৃজনবোধ আকস্মিক কোনো বিষয়ই ছিল না। বৈচিত্র্যিক জীবনের বিক্ষুব্ধ যাত্রায় টানাপোড়েনের হরেক বিপন্নতাকে যে মাত্রায় ডিঙিয়ে গেছেন তাও এক বৈপ্লবিক চেতনাসিদ্ধ মানবিক বোধের অনন্য সাবলীল উদ্যোমী যাত্রার অনুষঙ্গ। উপস্থিত বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা ও লেখনির অনবদ্য নান্দনিকতার স্বল্প সময়ের শিক্ষা জীবনের এক অনন্য রূপকল্প। শিক্ষকদের নজর কাড়তেও দমে যেতে হয়নি। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক অবিভক্ত ভারত এক সীমাহীন উন্মাদনায় পরিবেশ পরিস্থিতির যে টালমাটাল অবস্থা সেখানে বিদ্রোহী সত্তাও আগুন ঝরা লেখনিতে যে মাত্রায় উন্মত্ত আস্ফালনে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তা আজও বিস্ময়কর এক ঘটনাপ্রবাহ। নজরুলের শুধু যাপিত জীবনই নয় সৃষ্টিশীল জগতকে আলোচনায় আনতে তৎকালীন উপমহাদেশীয় বিক্ষুব্ধ আবহকে তুলে ধরতে না পারলে যথার্থভাবে নজরুলকে চেনাও মুশকিল।
বিশ শতকীয় নানামাত্রিক বিপরীত স্রোত অন্তর্নিহিত বোধে যে আগুনঝরা অনুভব তার বিস্ফোরণও ছিল এক সৃজন বোদ্ধার অবিস্মরণীয় কাব্য শৌর্য। পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো নজরুল আপন অভিজ্ঞতা আর সৃজন সত্তায় নিয়তই অনুভব করেন দীনহীন অতি সাধারণ মানুষের নিত্য জীবনযাপনের বহুমাত্রিক সংকট। তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য তার জীবনের নিয়মিত টানাপোড়েনের দুঃসহ ঘটনাপ্রবাহ।
তাই শান্ত তো থাকতেই পারেননি। বরং ভেতরের উদ্দীপ্ত চেতনায় তার বিস্ফোরণ হতেও সময় লাগেনি। উদীয়মান এক তারুণ্যের প্রবল আকাক্সক্ষায় নিজের বোধে যে বৈপ্লবিক তাড়না তা এক সময় দুরন্ত আবেগে উৎসারিত হলো। ইতোমধ্যে ১৯১৪ সালে বিশ্বময় ছড়ানো এক যুদ্ধের উন্মত্ততা ভারতবর্ষের পাদদেশে আছড়ে পড়ে। এক উদীয়মান তরুণ যুদ্ধের তেমন উন্মত্ততায় একেবারে দিশেহারা। ১৯১৭ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে যুদ্ধের কারণে গড়ে ওঠা বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিলেন। বৈপ্লবিক অনুরণন যার ভেতরের বোধে আজন্ম লালিত সেখানে বহির্বিশ্বের উন্মত্ত দাবানল নজরুলকে থামাতে পারবে কল্পনারও বাইরে। জীবন যার লড়াকু অভিগমন সেখানে যুদ্ধও তার জন্য এক অধীর আগ্রহের বিষয় হতে সময়ও লাগেনি। সুদূর করাচিতে সৈনিক জীবনের নবউত্থান। সেখানে লড়াইয়ের ফাঁক ফোকড়ে সংগীত বোধের মূর্ছনাও নাড়া দিত।
এক অভাবনীয় সংগীত যোদ্ধার নতুন গানের রাজার অত্যাধুনিক অভিষেক একটু উল্লেখ না করলেই নয়। সময়টা ছিল রবীন্দ্র সংগীত বলয়ের এক অপ্রতিরোধ্য আঙিনা। সমকালীন কোনো সংগীত সাধক কবিগুরুকে অতিক্রম করা দূরে থাক তেমন সুর মূর্ছনার সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠের জড়ানো। তাই রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে না পারায় সমকালীন সংগীত সাধকরা কবিকে একপ্রকার বর্জন করতে লাগলেন। নজরুলকে তেমন পথে হাঁটতেও হয়নি। সমকালীন বিজ্ঞ লেখকের কাছে জানা যায় এই বিপ্লবী সত্তা সবসময় রবীন্দ্র সংগীতে ডুবে থাকতেন। চর্চা করতেন।
অনুশীলনেও ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু যখন বাণী আর সুরে আপন সংগীত ভুবনের দ্বার উন্মোচন করলেন সেখানে বিস্মিত সবাই। কোথাও কোনো রবীন্দ্র ছাপই নেই। না বাণীতে না বৈচিত্রিক সুরের আলাপনে। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম নয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গেলেন সঙ্গীতঙ্গ নজরুল আপন মহিমান্বিত প্রতিভাদীপ্ত মনন আর সৃজন দ্যোতনায়। অপূর্ব এক নতুন যুগের সংগীতের ভিন্নমাত্রার নব আলোড়ন, আয়োজন।
নজরুলের সাহিত্যিক জীবন মাত্র ২০ বছরের। সংগীত সাধনার সময় আরও কম ১০ বছরেই লিখে ফেললেন ৩ হাজারেরও অধিক গানের বাণী সঙ্গে সুরব্যঞ্জনাও। লেটো গানের সঙ্গে যুক্ত ছন্নছাড়া নজরুল কিশোর বয়স থেকেই।
নিজের মতো করে গাইতেও পারতেন সুরেলা এক মধুর কণ্ঠে। শুধু প্রতিভা নয় সঙ্গে মনন, সৃজন শৈল্পিক সত্তা উজ্জীবিত বোধে অনুরণিত হতে সময় লাগতো না। নজরুলের সংগীত ভুবনে আজও তিনি একাধিকত্বে দর্শক শ্রোতার মনোরঞ্জন করেই যাচ্ছেন। ১৯২১ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে আগত যৌবনের উচ্ছ্বাস আর ভাবাচ্ছন্ন অনুভবে দেশ ও জাতিকে যা দিলেন তা আজও অপরাজেয় মহাকাব্যিক শক্তি। জীবনভর তারুণ্যের জয়গান গাওয়া এই অজেয় কাব্য আর সংগীত বলয়ের পুরোধা যা দিয়ে গেলেন বাংলাও বাঙালিকে তা এখনো বাঙালির উজ্জীবনি শক্তি। বিদ্রোহ, বিপ্লব নতুন সময়ের অবগাহনে নজরুলের বিকল্প একমাত্র তিনিই। মানুষে মানুষে মিলন সৌধে যেভাবে কাব্য লক্ষ্মীকে আরাধনাই শুধু নয় জয়গানে মুখরিত করলেন তা যেন বাঙালির জন্ম-জন্মান্তরের সম্পদ।
উপনিবেশিক নির্মম যাতনা, অচলায়তন সামাজিক ব্যবস্থা ভেতরে গেঁড়ে বসা অপসংস্কার উদ্দীপ্ত তারুণ্যের অভাবনীয় শৌর্য-বীর্যের বন্দনাই শুধু নয়, মূল শেকড়ের অন্তর্নিহিত ব্যবস্থায়ও এক আমূল পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিশোধনের পালা শুরু হয়ে গেল। তবে তারুণ্যের জয়গান গাওয়া এই চিরসবুজ নজরুল কখনো তার উদ্দীপ্ত চেতনা, বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্ব আর গভীর দেশপ্রেমের জায়গা থেকে সামান্যতম বিচ্যুত কিংবা বিচ্ছিন্ন হননি। ছন্নচাড়া নজরুলের জীবন যতই বৈচিত্র্যপূর্ণ হোক না কেন মূল আদর্শগত চেতনায় সামান্যতম আঁচড় না লাগাও আজন্ম স্বপ্ন সাধনা আর সুদীপ্ত উচ্চকণ্ঠের চিরস্থায়ী নির্মাল্য।
যেখানে অতি সাধারণ এক বালক থেকে কৈশোরের উদ্দীপ্ত ভাবসম্পদে দেশ-কালের ঊর্ধ্বে উঠে সমকালীন সমাজে শুধু যে ঝড় তুললেন তা কিন্তু নয়। বরং শতবর্ষ পার করা বিদ্রোহী আজও বিপ্লব, আন্দোলন আর অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উজ্জীবনি শক্তিমত্তায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে উৎসাহ-উদ্দীপনায় নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। নজরুলকে শুধু সমকাল কিন্তু আধুনিক নয় বরং চিরকালের বার্তাবহ এক অজেয়, অমর কাব্যিক মূর্ছনার অনবদ্য সাধন বলাই যায়।
আপন সংস্কৃতির বেড়াজালে নিজেকে সমর্পণ করলেন। ঐতিহ্যিক বোধকে উপজীব্য করতে দ্বিধাহীন চিত্তে সাহিত্যের ভাব-সম্পদে অবিমিশ্র করে দিলেন। ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সামাজিক প্রতিবেশ কখনো পিছু ছাড়েনি নির্বাক, নিস্তব্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত। সনটি ছিলো ১৯৪২। আগের বছর ১৯৪১ সালে কবি গুরুর প্রয়াণ। কবি গুরুর শবযাত্রায় নজরুল গভীর শোক গাঁথায় তাৎক্ষণিক এক সংগীত রচনা সে সময়ের অনবদ্য ঘটনা। জানা যায়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে নজরুল প্রথম ছুটে যান কলকাতার জোড়া সাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করে শোনালেন নজরুলের প্রিয় ও আরাধ্য কবিকে রবীন্দ্রনাথও নাকি দু’হাত বাড়িয়ে নতুন সময়ের আধুনিক বরপুত্রকে আলিঙ্গন করলেন। নজরুলও সজ্ঞান অবস্থায় জীবনভর তার প্রতিদান দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শবযাত্রায় নজরুলের সংগীত কণ্ঠে ধারণ করে সম্মিলিত সুরে গাওয়া হয়েছিল-
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিকে
জাগায়োনা জাগায়োনা
সারা জীবন ধরে যে আলো দিল
তাঁর ঘুম ভাঙায়োনো না।
১৯৪১ সালের কবি গুরুর চলে যাওয়া। ১৯৪২ সালে নজরুলের দূরারোগ্য ব্যাধিতে জীবন মন, কাব্যশক্তি অপসৃত হওয়া বাঙালি জাতির জন্য বেদনাক্লিষ্ট এক চরম দুঃসময়। ৩৪ বছরের ছন্দহীন, নির্বাক জীবনের পরিসমাপ্তি হয় ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট আমাদের বাংলাদেশে। এক গানে কবি বলেছিলেন, মসজিদের পাশে যেন কবর দেওয়া হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
মন্তব্য করুন: