প্রকাশিত:
১৯ মে ২০২৫, ১২:১২
অনেকেই মনে করেন, সুখী হতে হলে আগে অতীতের ক্ষত সারিয়ে তোলা দরকার। এটা অনেকটা যুক্তিযুক্ত মনে হতে পারে—যদি কোনও কিছু একসময় কষ্ট দিয়েছিল, তাহলে মনে হয় সেই ব্যথা পুরোপুরি সারাতে না পারলে সামনে এগোনো যাবে না।
কিন্তু যদি সেটা পুরোপুরি সত্য না হয়?
আমরা কেবল বর্তমান মুহূর্তেই অনুভব করতে পারি—সেটা সুখ হোক বা দুঃখ। আপনি এখন যা অনুভব করছেন, তা অতীতের কারণে নয়। বরং আপনি বর্তমানে কী নিয়ে ভাবছেন, সেটাই আসল কারণ।
মনোযোগের শক্তি
প্রায় একশ বছর আগে মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন, “আমার অভিজ্ঞতা নির্ধারিত হয় আমি যেটির প্রতি মনোযোগ দিই সেটির দ্বারা।” আধুনিক নিউরোসায়েন্স এই কথা আজ সত্য বলে প্রমাণ করেছে। আপনার আবেগগত অবস্থা সরাসরি নির্ভর করে আপনি কী নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন তার ওপর।
অর্থাৎ, কোনও কিছু আপনাকে আবেগগতভাবে আঘাত করতে পারবে না—যদি না আপনি সেটার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন।
এতে বোঝায় না যে কষ্টকর ঘটনা ঘটেনি। বরং আপনার মস্তিষ্ক সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করছে না, যতক্ষণ না আপনি নিজের মনোযোগ সেখানে ফেরত নিয়ে যাচ্ছেন।
কেন কষ্টদায়ক চিন্তায় ফিরে যাই?
মানব মস্তিষ্ক প্রাকৃতিকভাবে ঝুঁকির প্রতি মনোযোগ দিতে অভ্যস্ত। আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে পুরনো স্মৃতি মনে করতে না চাইলেও, কোনও নেতিবাচক স্মৃতি বা উদ্বেগ অজান্তেই আপনার মনোযোগ দখল করে নিতে পারে।
এই সময় আপনি শুধু ঘটনাটি মনে করেন না—আপনি সেই আবেগটাও আবার অনুভব করেন।
মানুষ প্রায়ই ভাবে, “আমার মাথা তো এমনই কাজ করে।” কিন্তু আপনি যখন বুঝতে পারেন যে আপনি এমন কিছু নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন যা কষ্টের কারণ, তখন আপনি আবার নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান।
মনোযোগ একটি দক্ষতা, জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়
সুসংবাদ হলো: মনোযোগ অনুশীলনের মাধ্যমে গড়ে তোলা যায়। এটি একটি পেশির মতো—চর্চা করলে শক্তিশালী হয়।
জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাষায়, মনোযোগ ‘অ্যাকটিভেশন-ইনহিবিশন’ মডেলে কাজ করে। আপনি যখন কোনও ইতিবাচক বিষয় নিয়ে মনোযোগ দেন (যেমন কৃতজ্ঞতার অনুভূতি), তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতিবাচক বিষয়গুলো দমন হয়ে যায়। এ কারণেই ‘গ্র্যাচিটিউড জার্নালিং’ বা কৃতজ্ঞতা নিয়ে লেখালেখি করলে মন ভাল হয়ে যায়—মস্তিষ্ক একইসঙ্গে ভালো ও খারাপের ওপর মনোযোগ দিতে পারে না।
আবেগ বদলানোর সহজ পদ্ধতি
যখন আপনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করেন, নিচের সহজ পদ্ধতিটি অনুসরণ করুন:
১. আবেগটি খেয়াল করুন
যদি উদ্বিগ্ন, রাগান্বিত বা দুঃখিত থাকেন, নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: “আমি এখন কী নিয়ে ভাবছি?”
২. ক্যাটাগরি নির্ধারণ করুন
প্রায় সব আবেগই দুইটি ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে:
আপনি যা চান না: শত্রু, টাকা-পয়সার অভাব, পারিবারিক কলহ
আপনি যা চান: ভালোবাসা, নিরাপত্তা, সম্মান
যখন বুঝতে পারবেন আপনি এমন কিছু নিয়ে মনোযোগ দিচ্ছেন যা আপনি চান না, তখন মনোযোগ ঘুরিয়ে দিন এমন কিছুতে যা আপনি চান। যেমন: একটি লক্ষ্য, একটি সুন্দর স্মৃতি, অথবা যেটার জন্য আপনি কৃতজ্ঞ।
এটা এড়িয়ে যাওয়া নয়—এটা বেছে নেওয়া মনোযোগ। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, কষ্টদায়ক চিন্তা থেকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার দক্ষতা মানসিক সুস্থতা রক্ষার অন্যতম কার্যকর উপায়।
নেতিবাচক ভবিষ্যৎ ভাবনার গোপন খরচ
পেছনের কষ্ট নিয়ে ভাবা যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা আরও বিপজ্জনক। উদ্বেগ সবসময় ভবিষ্যতের বাসিন্দা। এটি কল্পিত ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়েই বেঁচে থাকে। যদিও ঘটনাগুলো ঘটেনি, তবু আপনার মস্তিষ্ক সেগুলিকে বাস্তব বলে অনুভব করে।
যখন আপনি বারবার যা চান না সেটির কথা ভাবেন, তখন শুধু অনুভূতিই নষ্ট হয় না—আপনার আচরণেও এর প্রভাব পড়ে। আপনি আশাহীন হয়ে পড়েন, অনুপ্রেরণা হারান, এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও পিছিয়ে যান।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্টিস্ট জোসেফ লে-ডক্স বলেন, মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ কেবল মানসিক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের কৌশল নয়—এটি দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সহনশীলতার চাবিকাঠি।
মনোযোগই আপনার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ
জীবনে সবকিছু আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু আপনি কী নিয়ে মনোযোগ দেবেন, সেটা আপনি ঠিক করতে পারেন। আর সেই একটি সিদ্ধান্তই বাকিসব নির্ধারণ করে।
ভাবুন, মনোযোগ আপনার আবেগের গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল। আপনি কোথায় ঘোরাচ্ছেন সেটা নির্ভর করে আপনি কেমন সফরে যাচ্ছেন। আপনি যদি সর্বদা যা নেই বা যা ভুল হতে পারে সেদিকে মনোযোগ দেন, আপনার অনুভবও তেমনই হবে। কিন্তু আপনি যদি অভ্যাস করেন যা চাইছেন, যা ভালো, যা সম্ভব—সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে, তাহলে আপনার জীবনও সেই দিকে অগ্রসর হবে।
এটা ভাবার বিষয় নয় যে “সব ঠিক আছে”। বরং এটি নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার বিষয়—কোন চিন্তা আপনার মানসিক জায়গা দখল করবে, সেই সিদ্ধান্ত আপনার।
আপনার প্রতিটি ক্ষত সারাতে হবে না ভালো বোধ করতে। বরং কেবল সেই ক্ষতের ওপর মনোযোগ দেওয়া বন্ধ করলেই চলবে।
মন্তব্য করুন: