শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কেলি রদ্রিগেজ
  • প্রথমবার সচিবালয়ে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • এস আলমের ঋণ জালিয়াতি, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ১৩ জনকে তলব
  • সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
  • ড. ইউনূসের ভিশনের দিকে তাকিয়ে যুক্তরাজ্য: ক্যাথরিন ওয়েস্ট
  • ২০২৫ সালে সরকারি নির্মাণে পোড়া ইট ব্যবহার বন্ধ হবে
  • নাম ও পোশাক বদলাচ্ছে র‌্যাব
  • গণহত্যা মামলায় ৮ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ
  • আজারবাইজানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সিঙ্গাপুরের সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা

সমকালীন প্রসঙ্গ

উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ওষুধের দাম

হাসান মামুন

প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২৩, ১৬:৩৫

হাসান মামুন

নিত্যপণ্যের দাম একযোগে বাড়লে জনজীবনে এর কী প্রভাব পড়ে, তা আমরা জানি। এ অবস্থায় বহুল ব্যবহৃত ওষুধের দামও বেড়ে গেলে কী হয়, তা-ও সহজে অনুমেয়। গত এক-দেড় বছরে সে অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে।

বলে রাখা ভালো, প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রায় ৯৫ শতাংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। আমাদের কোম্পানিগুলো এমনকি পশ্চিমা দুনিয়ায়ও তা রপ্তানি করছে। দেশে উৎপাদিত যেসব পণ্য নিয়ে গর্ব করা যায়, তার মধ্যে রয়েছে ওষুধ। যদিও এর কাঁচামালের সিংহভাগ আমদানি করতে হয়। ওষুধ প্রস্তুত করতে গিয়ে এখানে যে মূল্য সংযোজন হয়ে থাকে, সেটাকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। দেশের ভেতর থেকে ওষুধ শিল্পে ব্যবহারযোগ্য কাঁচামালের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগও রয়েছে। তাতে মূল্য সংযোজন বাড়বে। ওষুধের দাম কিছুটা কমানোও সম্ভব হবে হয়তো। দেশে উৎপাদিত ওষুধের দাম তুলনায় কম বলে এ খাতের প্রতিনিধিরা দাবি করে থাকেন। তবে ওষুধের দাম সম্প্রতি যেভাবে বেড়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। যে সামান্য পরিমাণ ওষুধ আমদানি হয়ে থাকে, তার দামও বেড়েছে। জীবন রক্ষাকারী ওষুধের আমদানি ব্যাহত হওয়ার খবরও মেলে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও এলসি জটিলতা এ জন্য প্রধানত দায়ী। চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি অনেকখানি কমে আসার মতো উদ্বেগজনক খবরও রয়েছে।

সামগ্রিকভাবে আমদানি হ্রাসের প্রবণতা চলছে আমাদের অর্থনীতিতে। এ ধারায় খাদ্যপণ্য, জ্বালানি পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজের মতো অনেক জরুরি পণ্যের আমদানিও কমে এসেছে, যা জনগণের জন্য অশনি সংকেতস্বরূপ। এর সঙ্গে গত ক’মাসে ওষুধের কাঁচামাল এবং এ শিল্পের মেশিনারিজ আমদানি হ্রাসের খবর মিলছে। যেটুকু আমদানি করা যাচ্ছে, তাতেও খরচ পড়ছে বেশি। উৎসে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অব্যাহতভাবে কমে যাওয়ায় খরচ বাড়ছে। পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে বৈকি। পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস-বিদ্যুতের দাম এরই মধ্যে দফায় দফায় বাড়িয়েছে সরকার। এসবের প্রভাবে ওষুধ উৎপাদন ব্যয় বাড়ার যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তা উপেক্ষার সুযোগ নেই। সম্প্রতি এক সহযোগী দৈনিকে খবর বেরিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদিত ওষুধের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ২৪ শতাংশ। তারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মসূচিতে ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। এতে বোঝা যায়, একই খাতে কাজ করা বেসরকারি কোম্পানিগুলো কেন ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে।

কোম্পানি অবশ্য একা দাম বাড়াতে পারে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তাকে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদন না নিয়ে কোনো কোম্পানি কি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে? হতে পারে, পুরোনো স্টকের পণ্যের গায়ে নতুন দাম বসিয়ে সরবরাহ করেছে। বর্ধিত দামে বিক্রির জন্য কিছু ওষুধের উৎপাদন বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে এর মধ্যে। তখন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা ওই ওষুধের ভোক্তাদের কাছ থেকে হয়তো বাড়তি দাম আদায় করেছে। এক্ষেত্রে বড় অভিযোগ হলো, ওষুধ কোম্পানির দাম বৃদ্ধির আবেদন যথেষ্ট পরীক্ষা না করেই মঞ্জুর করা হচ্ছে। ওষুধ প্রশাসন নাকি প্রভাবশালী কিছু কোম্পানির হাতে জিম্মি। কোম্পানির দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বিচারে তার সক্ষমতার ঘাটতির কথাও বলা হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন থাকলেও পরিস্থিতির সুযোগে এটা হয়তো বেশি হারে বাড়ানো হচ্ছে। সব খাতেই উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ প্রবণতা রয়েছে। সরকারের দায়িত্ব হলো, এটাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা। ওষুধের মতো পণ্যের বেলায় এটা আরও বেশি জরুরি।


অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের একটি তালিকা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত এসেনসিয়াল ড্রাগস ছাড়াও বেসরকারি কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। যেমন প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। সরকারের পক্ষে এগুলোর দামই কেবল ওষুধ প্রশাসন নির্ধারণ করে। বেশ ক’মাস আগে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর দাবি মেনে এসব ওষুধের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়।

কোম্পানিগুলোর দাবি, অনেক আগে নির্ধারিত দামে ওইসব ওষুধ সরবরাহ করা তাদের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে লোকসান বয়ে আনছিল! এসব দাবিও কি যথেষ্ট পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে? এসব ওষুধ সাধারণভাবে বহুল ব্যবহৃত এবং সে জন্যই তালিকাভুক্ত। সব কোম্পানি যে একই উৎস থেকে আনা কাঁচামাল ব্যবহার করে, তাও নয়। সবাই একই মানের মোড়কও ব্যবহার করে না। ওষুধ সংরক্ষণ আর পরিবহনে অভিন্ন মানও কি বজায় রাখে সবাই? এক্ষেত্রে ঘোষিত মান রক্ষার বিষয়টিও অব্যাহতভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এমনকি দফায় দফায় তাপপ্রবাহ ও লোডশেডিং চলাকালে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফার্মেসিগুলোয় ওষুধ কতটা সুরক্ষিত থাকছে, সংগতভাবেই উঠেছে সে প্রশ্ন। ওষুধের ক্ষেত্রে দামের বিষয়টিই একমাত্র বিবেচ্য নয়!

যেখানে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষ বহুসংখ্যক এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন-মধ্যবিত্তের অবস্থাও কাহিল, সেখানে ওষুধের দামের বিষয়টি আবার আলাদা করে গভীরভাবে বিবেচ্য। এদেশে চিকিৎসা বাবদ রাষ্ট্রীয় ব্যয় বেদনাদায়কভাবে কম। এ জন্য ব্যক্তিকে বলতে গেলে পুরো ব্য়য়টাই তার পকেট থেকে করতে হয়। এর সিংহভাগ আবার চলে যায় ওষুধ কেনায়। ডাক্তারের ফি ও রোগ নির্ণয়ে যে ব্যয় হয়ে থাকে, সেখানেও একই সময়ে খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে দেখা চাই, উৎপাদন ও সেবা প্রদানকারীর ব্যয় আসলে কতটা বেড়েছে এবং দাম বাড়লেও কতটা বাড়া উচিত। কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধির হার নিয়েও কিন্তু বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ রোগী একত্রে চার-পাঁচটি ওষুধ সেবন করে থাকে। একই পরিবারে এমন একাধিক রোগী এবং তাদের অন্তত একজন পরনির্ভর হলে ওষুধের দাম বৃদ্ধির এ সময়টায় পরিস্থিতি হয়ে উঠবে জটিল। এতে নিজ দায়িত্বে ওষুধ কমিয়ে খাওয়া কিংবা চিকিৎসায় ধারাবাহিকতা বজায় না রাখার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। আর তাতে বেড়ে যাবে জনস্বাস্থ্য জটিলতা।

এমনিতেই একটা নজিরবিহীন ও দীর্ঘ করোনা পরিস্থিতি গেছে আমাদের ওপর দিয়ে। তাতে চিকিৎসা বাবদ খরচ বেড়ে গেছে অনেক পরিবারে। অনেকের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য জটিলতা, বিশেষত যাঁদের আগে থেকে রোগব্যাধি ছিল। দেশে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা ও ক্যান্সারের সমস্যাও কম নয়। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োজন ধারাবাহিক চিকিৎসা এবং বরাদ্দ রাখতে হয় অর্থ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমদানি করা ওষুধ, যেমন ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। এর আমদানিকারকরাও দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। দেশে উৎপাদিত স্যালাইন, ভ্যাকসিন প্রভৃতির দামও কি বাড়েনি?

সরকার এ ক্ষেত্রে নিশ্চয় ভূমিকা রাখতে পারে কর-শুল্ক কমিয়ে। প্রস্তাবিত বাজেটে ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জামের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত সুবিধা আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অধিকতর কার্যকর ছাড় দিয়ে ওষুধের বেড়ে চলা দাম নিয়ে উদ্বিগ্নদের মনে ভরসা জোগানো জরুরি। ওষুধ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার যে কোনো সুযোগ যত্নের সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। এ খাতের সব রকম আমদানি যেন নির্বিঘ্ন থাকে। কোম্পানির গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দিয়েও ওষুধ উৎপাদন ব্যয় কমানো যেতে পারে। তাহলে এর রপ্তানিতেও হয়তো কিছু সুফল মিলবে। এ খোঁজও নিন– ওষুধের কাঁচামালের দাম ইতোমধ্যে নিম্নমুখী কিনা বিশ্ববাজারে!

হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর