শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কেলি রদ্রিগেজ
  • প্রথমবার সচিবালয়ে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • এস আলমের ঋণ জালিয়াতি, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ১৩ জনকে তলব
  • সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
  • ড. ইউনূসের ভিশনের দিকে তাকিয়ে যুক্তরাজ্য: ক্যাথরিন ওয়েস্ট
  • ২০২৫ সালে সরকারি নির্মাণে পোড়া ইট ব্যবহার বন্ধ হবে
  • নাম ও পোশাক বদলাচ্ছে র‌্যাব
  • গণহত্যা মামলায় ৮ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ
  • আজারবাইজানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সিঙ্গাপুরের সহায়তা চান প্রধান উপদেষ্টা

মানবসম্পদ

অভিবাসন বাড়লেও রেমিট্যান্স বাড়ছে না কেন?

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী

প্রকাশিত:
৮ জুন ২০২৩, ১৬:৩৩

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী

আমাদের অর্থনীতি যে তিনটি প্রধান খাতের ওপর নির্ভর করে, এর একটি হলো রেমিট্যান্স বা অভিবাসী প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা। যেমন ২০২২ সালে রেমিট্যান্স ছিল রপ্তানি আয়ের ৪৩ শতাংশের সমপরিমাণ। স্বাভাবিকভাবেই এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় উপাদান। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমাদের দেশ থেকে যত সংখ্যক কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন, সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। যেমন ২০২২ সালে ২১ লাখের বেশি লোক বিদেশ যাওয়া সত্ত্বেও আগের বছরের তুলনায় (২০২১ সালে মাত্র ৬ লাখ লোক বিদেশে গিয়েছিলেন) রেমিট্যান্স কমে গেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩, ২০১৬-১৭ বাদ দিলে ২০১১-’২০ সালে প্রতি বছরে রেমিট্যান্স ১০ থেকে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে গতি কিছুটা মন্থর হয়ে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ২০২২ সালে এসে আগের বছরের তুলনায় ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমে যায়। অবশ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আগের অর্থবছরের তুলনায় রেমিট্যান্স ১৭ শতাংশ বেড়েছে।

অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, গত দেড় দশকে ব্যাংকের বিভিন্ন সংস্কারের কারণে রেমিট্যান্স প্রেরণের আনুষ্ঠানিক মাধ্যমগুলোর যে ব্যবহার বেড়েছিল, তা আবার কমতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ উৎসাহিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ডিলারদের সংগঠন বিএএফইডিএ ব্যাংকগুলোকে আনুষ্ঠানিক বিনিময় হারের চেয়ে বেশি টাকা ডলারপ্রতি অর্থ প্রদানে ছাড় দিয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক অভিবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করলে যে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হতো, সেটাকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনতে হলে যেসব নথিপত্র দেখাতে হতো, তাতেও ছাড় দিয়েছে। সর্বোপরি রেমিট্যান্স প্রেরণের খরচ ৪ শতাংশের কমে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যা বহু দেশের ক্ষেত্রে এখনও ৬-৭ শতাংশ।

একটি ধারণা প্রচলিত, অভিবাসন বাড়লেই রেমিট্যান্স বাড়বে। অথচ গবেষণা বলে, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি শুধু অভিবাসীর সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়। যেমন ২০০৮ সালে আগের বছরের তুলনায় অভিবাসন বেড়েছিল মাত্র ৫ শতাংশ। অথচ রেমিট্যান্স বেড়েছিল ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৫ সালে অভিবাসন বেড়েছিল ৩১ শতাংশ। কিন্তু রেমিট্যান্স বেড়েছিল মাত্র ২ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাইরে অভ্যন্তরীণ যেসব ঘটনা রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি সীমিত করে রাখে, এর মধ্যে রয়েছে– ভিসা ক্রয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সির দেশের বাইরে রেমিট্যান্স পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বাজারের মধ্যে তফাত, কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে এলসি খোলার সময় আন্ডার ইনভয়েসিং, কালোবাজারে বিনিয়োগ, ব্যাংকিং খাতের অনিয়মতান্ত্রিকতার কারণে অভিবাসী ও তাদের পরিবারের আস্থা হ্রাস ইত্যাদি।

 

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী একজন অভিবাসীর বিদেশে যেতে প্রায় ৫ হাজার ডলার খরচ হয়। এর মধ্যে অন্তত ৩ হাজার ডলার দিতে হয় ভিসা প্রদানকারী রিক্রুটিং এজেন্সিকে। দালাল, টিকিট, রিক্রুটিং এজেন্সির মুনাফা মিলিয়ে বাকিটা খরচ হয়। তাহলে গত বছর ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩টি ভিসা কিনতে রিক্রুটিং এজেন্সি খরচ করেছে ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ তারা বিদেশেই সংগ্রহ করেছে। বলাবাহুল্য, এটি অভিবাসীদের রেমিট্যান্স থেকেই এসেছে। এই ৩ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ২০২২ সালে প্রেরিত রেমিট্যান্সের সঙ্গে যোগ করলে তা ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বাড়ত। এমনি করে ব্যবসায়ীদের আন্ডার ইনভয়েসিং, চোরাকারবারিদের কালোবাজারের চাহিদাগুলো এক করা হলে বোঝা যাবে কতটা অর্থ অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় যেতে বাধ্য হচ্ছে।

অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় টাকা এলে ক্ষতিটা সরকারের। তবে অভিবাসীর দিক থেকে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। বরং তার লাভই বেশি। সামাজিক কিছু উদ্দেশ্যও হাসিল হচ্ছে। যেমন অনেক সময় অভিবাসী তাঁর বাবা ও স্ত্রীকে টাকা পাঠান গোপনে। বাবাকে জানাতে চান না স্ত্রীকে কত পাঠালেন। স্বামী টাকা নষ্ট করতে পারে বলে লুকিয়ে নিজের মা অথবা ভাইয়ের কাছে পাঠান নারী অভিবাসী। এ ধরনের সেবা আনুষ্ঠানিক চ্যানেল কখনোই প্রদান করতে পারবে না। ফলে কিছু মানুষের কোনো কোনো সময়ে অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় সেবা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যাবে। এ অবস্থায় সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। ছাড় দিয়ে হলেও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রেরিত অর্থ আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে চাইলে এবং এই অর্থ দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য করতে চাইলে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।

সরকার কীভাবে উদ্যোগী হতে পারে? শোনা যায়, অনেক কম খরচে ডিজিটাল মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ সম্ভব। সে ক্ষেত্রে দ্রুত গবেষণা করা প্রয়োজন ডিজিটালি রেমিট্যান্স প্রেরণের পথগুলো কতটা উন্মুক্ত করা যায়। আমাদের দেশের লোক স্বল্পশিক্ষিত। ফলে ডিজিটাল মাধ্যমে হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য সরকারের উচিত দ্রুত ভোক্তাদের সুরক্ষায় একটি আইন পাস করা। যেন হ্যাকারের কারণে অর্থ অন্যত্র চলে গেলে সেই দায় ব্যাংক গ্রহণ করে। কোনোভাবেই অভিবাসীর ঘাড়ে যেন ক্ষতি চাপিয়ে দেওয়া না হয়।

বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠালে প্রদেয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা বাড়িয়ে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের সমপর্যায়ে আনা দরকার। বিশেষ করে শ্রম অভিবাসীদের জন্য এ ব্যবস্থা করা গেলে তাঁরা আর অবৈধ চ্যানেলে ঝুঁকবেন না। করনীতিতেও সংস্কার আনা দরকার, যাতে করের ভয়ে ব্যবসায়ীরা আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে না যান। খেলাপি ঋণ, টাকা পাচারসহ নানা কারণে ব্যাংক খাতের ওপর যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সি যাতে বৈধ পথে অভিবাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে, সে ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে।

বিদেশ যেতে অতিরিক্ত খরচ প্রেরণকারী এবং গ্রহণকারী দেশ কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়। এটি সমাধানে প্রেরণকারী এবং গ্রহণকারী দেশ বসে আলোচনা করে মধ্যস্বত্বভোগীদের চিহ্নিত করতে পারে। দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের জন্য কারিগরি শিক্ষাকে মূল শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। দক্ষ জনশক্তি হিসেবে সনদ থাকলে বিদেশে গিয়ে সহজে কাজ খুঁজে নেওয়া যায়। বিদেশে যাওয়ার আগে ব্যাংক হিসাব খোলা সরকার এরই মধ্যে বাধ্যতামূলক করেছে। এর সুফল আশা করি পাওয়া যাবে।

নারী ও পুরুষের রেমিট্যান্সের হিসাবটা আলাদা করা যেতে পারে। কারণ, রামরু গত ৭ বছরে একই পরিবারগুলোর ওপর ৩ বছর পরপর সমীক্ষা করে দেখেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এসে পুরুষ অভিবাসী পরিবারে রেমিট্যান্স কমেছে। অন্যদিকে নারী অভিবাসীর ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স ২০১৭ সালের তুলনায় বেড়েছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে পুরুষের তুলনায় নারী অভিবাসীর রেমিট্যান্স অনেক বেশি স্থিতিশীল। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারী অভিবাসী প্রেরণ করা গেলে কম খরচে বেশি রেমিট্যান্স আনা সম্ভব।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও বলে আসছে, রেমিট্যান্সের ৫ শতাংশ অভিবাসীদের কল্যাণে খরচ করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে অভিবাসীদের জন্য যে খরচ করা হচ্ছে তা ১ শতাংশেরও কম। এসব সংস্কার আনা গেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে। একই সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ভালোভাবেই পূরণ করতে পারব। তবে মনে রাখতে হবে, ঘাটতি পূরণের হাতিয়ার হিসেবে যেন অভিবাসীদের ব্যবহার করা না হয়। বিভিন্ন সেবা দিয়ে তাঁদের বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী করে তুলতে হবে।

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী: চেয়ারপারসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রামরু


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর