প্রকাশিত:
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৪০
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিমাসে বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ করছে সরকার। তারপরও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দামের মধ্যে বিশাল ব্যবধান থাকছে।
বর্তমানে ভারতের কলকাতা ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিজেল ও পেট্রল লিটার প্রতি পার্থক্য থাকছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। দামের এ বিশাল পার্থক্যের কারণেই বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা জ্বালানি তেল অবাধে পাচার হচ্ছে ভারতে। দুই দেশের দামের পার্থক্য ৫ টাকার মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ডলার সংকটে আমদানি করা জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অন্যদিকে ভারতে অবাধে পাচার হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি তেল। এতে দেশের চাহিদা পূরণে সরকারকে বাড়তি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। যার চাপ বাড়ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতে ডিজেলের দাম বাংলাদেশের বাজারদরের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান বাড়াটাই স্বাভাবিক। তাই দুই দেশের মধ্যে তেলের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে, এতে তেল পাচারের ঝুঁকিটাও কমবে। একইসঙ্গে বাড়তি তেল আমদানির চাপও জ্বালানি তেল পাচার বন্ধ করা গেলে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে সরকারকে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। প্রতিবছর জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় মেটাতে সরকারকে প্রায় ৫ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হচ্ছে, তার ৭৩-৭৫ শতাংশই ডিজেল আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে অবাধে জ্বালানি তেল পাচারের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে সরকারকেও।
জানা গেছে, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ডিজেলের দাম বেশি হওয়ায় পাচারে সক্রিয় একটি অসাধু চক্র। বিভিন্ন স্থলবন্দর ও সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন অলিখিতভাবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল।
তেল পাচারের অভিযোগ স্বীকার করেছেন দেশটির ট্রাকচালক ও সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারাও। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তেলের মূল্য কম। এর ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাকগুলোর তেলের ট্যাংকি বাংলাদেশে ঢুকেই ভর্তি করা হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ার করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেন, ভারতে তেল পাচারের বিষয়টি খোঁজখবর নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। কোনো অবস্থাতেই দেশ থেকে জ্বালানি তেল পাচার হতে দেওয়া যাবে না।
গত শুক্রবার ভারতের কলকাতায় ডিজেল প্রতি লিটার ৯১.৭৬ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৩০.৪৯ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১০৫.৫০ টাকায়। কলকাতায় প্রতি লিটার পেট্রল ১০৪.৯৫ রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪৯.২৫ টাকা) বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি লিটার পেট্রল বিক্রি হচ্ছে ১২৭ টাকায়। এ অবস্থায় দুই দেশের ডিজেলের দামের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে প্রতি লিটারে ২৪.৯৯ টাকা এবং পেট্রলের পার্থক্য ২২.২৫ টাকা। সীমান্তের এপার ও ওপারের মধ্যে দামের এ ব্যবধানই সীমান্তের ভারতীয় অংশে জ্বালানি পাচারকারীদের কাছে বড় ব্যবসায়িক সুযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। এ সুযোগে সীমান্তে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাচার চক্র। ফলে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ লিটার ডিজেল চোরাই পথে প্রতিবেশী দেশে ঢুকছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ডিজেলের দামের পার্থক্য ২৫ টাকার মতো। যার কারণে পাচার হচ্ছে। যদি দুই দেশের জ্বালানি তেলের দামের পার্থক্যটি কমিয়ে আনা যায় তাহলে অনেকটাই পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে পাচারের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হলে পাচার কমে আসবে।
বিভিন্ন বন্দরের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে প্রায় এক হাজার ট্রাক আমদানি পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে। তারা ফেরার সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন বন্দর থেকে ট্যাংক পূর্ণ করে ডিজেল নিয়ে যায়। অনেকে আবার আলাদা ট্যাংকে করেও তেল নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বন্দর এলাকার বিভিন্ন তেল পাম্প থেকে তেল এনে প্রতিবেশী দেশের ট্রাকচালকদের কাছে গোপনে বিক্রি করেন স্থানীয় তেল ব্যবসায়ীরা। এসব ট্রাকচালকদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে পাশের দেশে বিপুল পরিমাণ ডিজেল পাচার হচ্ছে। এছাড়া দেশের সীমান্ত দিয়েও ডিজেল পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তবে বেনাপোলসহ বিভিন্ন বন্দরে এখন বিজিবির বাড়তি তৎপরতায় ডিজেল পাচারের প্রবণতা আগের তুলনায় কমেছে বলেও জানা যায়।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে তেল পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে পাচার রোধে জ্বালানি তেলের দাম যদি বাড়ানো হয়, তাহলে মানুষ ক্ষেপে যাবে। এজন্য একে ব্যালেন্স করতে হবে। মানুষের প্রত্যাশা ও বিশ্ববাজারে তেলের দামের যে ফর্মুলা আছে সবকিছু মিলিয়ে আমরা একটি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করবো।
স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৪টি স্থলবন্দরের মধ্যে ১৫টি স্থলবন্দর (বেনাপোল, ভোমরা, বুড়িমারী, তামাবিল, সোনাহাট, আখাউড়া, নাকুগাঁও, বিলোনিয়া, গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী, শেওলা, সোনামসজিদ, হিলি, বাংলাবান্ধা, বিবিরবাজার ও টেকনাফ) চালু রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক কোটি ৮৭ লাখ ১২ হাজার ৪২ মেট্রিক টন মালামাল আমদানি-রপ্তানি করা হয়েছে। এ পরিমাণ পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৫টি ট্রাক যাতায়াত করেছে। যেসব গাড়ি সীমান্তে মালামাল আনা-নেওয়া করে সেগুলো ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি ধারণ করতে পারে। কোনো কোনো ট্রাকে আবার ৪০০ থেকে ৫০০ লিটার তেল নেওয়ার মতো ট্যাংকিও আছে।
মন্তব্য করুন: