প্রকাশিত:
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫
রাঙ্গামাটিতে শুক্রবারের সহিংসতার পর এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় শহরে ১৪৪ ধারা জারি রেখেছে প্রশাসন। ওই দিনের সহিংসতায় রাঙ্গামাটির বনরূপা বাজার ও আশপাশের এলাকা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সহিংসতার ক্ষত।
দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে আঞ্চলিক পরিষদের গ্যারেজে রাখা ৯ গাড়ি। হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রিগ্যাল ফার্নিচার শো রুম, রাঙ্গামাটি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হোটেল গ্র্যান্ড মাস্টার, পেট্রোল পাম্প, রূপালী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, সীমান্ত ব্যাংক। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনরূপা, দক্ষিণ কালিন্দিপুর, বিজন সরণি, উত্তর কালিন্দিপুর, হাসপাতাল এলাকার ছোটবড় অন্তত ১০০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পুড়ে গেছে শহরের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল সঞ্চালন লাইন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শনিবার রাঙ্গামাটির বনরূপার বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসেনি। বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মালামাল। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বেশ কিছু দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়ে গেছে। আতঙ্কের মাঝেই অনেকে এসেছিলেন নিজের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ নিতে। কয়েকজন সবজি বিক্রেতা রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের মালামাল কুঁড়িয়ে নিচ্ছে। শহরের অন্তত তিনটি স্পটে গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবারের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অনেকই ভয়ে মুখ খলছে না। পরবর্তী হামলার ভয়ে অনেকেই রয়েছেন আতঙ্কের মধ্যে।
বনরূপা বাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া কুলিং কর্নারের মালিক সুমন চাকমা বলেন, ‘তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নটা পুড়ে গেছে। আমার দোকানে ৮ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সেগুলো রক্ষা করতে পারিনি।’
সবজি বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শনিবার বিক্রির জন্য ৫০ হাজার টাকার সবজি এনেছিলাম চট্টগ্রাম থেকে। সংঘর্ষের সময় সব তছনছ হয়ে গেছে। এখন যা পাচ্ছি খুঁজে নিচ্ছি।’
ডিডিএন নেটওয়ার্কের ব্রাঞ্চ ইনচার্জ লোকমান হোসেন বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে সংঘর্ষ চলাকালে বনরূপা এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় রাঙ্গামাটি শহরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের মূল সঞ্চালন লাইন। এতে অন্তত একলাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
রাসেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী ঊষা চাকমা বলেন, ‘বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান ঘিরে কয়েক লাখ টাকার বৌদ্ধমূর্তি, রংবস্ত্রসহ বিভিন্ন ধর্মীয় জিনিসপত্র ধার-দেনা করে বিক্রির জন্য কিনেছিলেন। এখন আগুনে পুড়ে নিমিষে সব শেষ হয়ে গেছে।’
আঞ্চলিক পরিষদের গ্যারেজ যেন ধ্বংসস্তূপ
বনরূপা বাজারে সংঘর্ষের শুরু হলেও পরে তা ছড়িয়ে যায় শহরের কালিন্দিপুর এলাকা পর্যন্ত। এ সময় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে গেছে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেল।
সরেজমিনে দেখা যায়, গ্যারেজে রাখা গাড়িগুলো একেবারে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আঞ্চলিক পরিষদের ভবনও।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিস সহকারী মজিবুর রহমান বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে একদল দৃর্বৃত্ত এসে গ্যারেজে রাখা গাড়িতে আগুন দেয়। এ সময় আঞ্চলিক পরিষদের সাতটি গাড়ি এবং আঞ্চলিক পরিষদের চালকের দুটি গাড়িসহ মোট ৯টি গাড়ি পুড়ে গেছে।
মন্দির-মসজিদে হামলা
সংঘর্ষ চলাকালে হামলা হয় রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপা জামে মসজিদ ও কাঁঠালতলী এলাকার মৈত্রী বিহারে হামলার ঘটনা ঘটে। বনরূপা জামে মসজিদের বেশ কয়েকটি জানালা ভাঙচুর হলেও হামলায় বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মৈত্রী বিহারের।
শনিবার বিকেলে মৈত্রিবিহার ঘুরে দেখা যায়, বিহারের আসবাবপত্র, তৈষজপত্র, রান্না এবং খাওয়ার বিভিন্ন উপকরণ বিহারের ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বিহারের নান্দাসারা ভিক্ষু বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে ৫০-৬০ জনের দল একসাথে পুরো বিহারে ভাঙচুর শুরু করে। পাঁচটি দানবক্সের মধ্যে দুটি তারা লুট করে নিয়ে যায়। বাকি তিনটি ভেঙে টাকা নিয়ে যায় হামলাকারীরা। ঘটনার পর বিহারে উপাসনা করতে আসা দায়ক-দায়িকারা আসতে পারছে না। আমরা নিজেরাও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি।’
অন্যদিকে বনরূপার বাসিন্দা মনির হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীর মিছিলে থাকা দুর্বৃত্তরা মসজিদে পাথর ছুড়লে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এতে কোনোভাবেই সাধারণ পাহাড়িরা জড়িত না।’
সহিংসতার এ ঘটনার জন্য পূর্বে ঘটা ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচার না হওয়াকে দুষছেন চাকমা সার্কেলের প্রধান রাজা দেবাশীষ রায়।
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে রাঙ্গামাটিতে চারটি এমন সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো ১৯৯২ সালের ২০ মে; ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর; ১০-১৫ জানুয়ারি ২০১৫ এবং ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪। কিন্তু এসব হিংসাত্মক কার্যকালাপের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়নি, সেটা যেই জাতি হোক-সম্প্রদায় হোক।’
‘এসব বিষয় ইনস্টিটিউশনাল মেমোরিতে থাকা উচিত। তথ্যগুলো ডিসি অফিস ও এসপি অফিসে সংরক্ষিত থাকা উচিত। কারণ এমন ঘটনা প্রথমবার না। অবশ্যই যারা আগে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা যদি শাস্তি না পেয়ে থাকে তাহলে তারাতো ভাববে আমরাতো আইনের আওতায় আসি নাই। সরকারকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, আইন নিজের হাতে নেওয়া যাবে না।’- রাজা দেবাশীষ রায়।
রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ বলেন, ‘রাঙ্গামাটি শহরে আমরা যুগের পর যুগ একসঙ্গে সম্প্রীতি বাজায় রেখে বসবাস করে আসছি। একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি তৈরি করছে।’
এ সময় তিনি রাঙ্গামাটি শহরবাসীকে কোনো গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানান।
রাঙ্গামাটি সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মু. সাইফুল উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে রাঙ্গামাটির পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেনা, বিজিবি, পুলিশ, র্যাবসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা টহলে আছেন।’
মন্তব্য করুন: