রবিবার, ৬ই অক্টোবর ২০২৪, ২১শে আশ্বিন ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ব্যাংক নোটে নতুন নকশা, বাদ যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর ছবি
  • মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল ভিসা দেওয়ার আহ্বান ড. ইউনূসের
  • ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতির শোক
  • সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল হবে: আসিফ নজরুল
  • বৈরী আবহাওয়া, উপকূলীয় অঞ্চলে নৌযান চলাচল বন্ধ
  • শহীদ পরিবারের পক্ষে আজ মামলা করবে নাগরিক কমিটি
  • ৪ বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত
  • সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা কামালসহ গ্রেপ্তার ৪
  • চুক্তিতে খাদ্য সচিব হলেন ইলাহী দাদ খান
  • সুপারশপে আজ থেকে পলিথিন ব্যাগ বন্ধ

স্কুল যেন না হয় নির্যাতন কেন্দ্র

শ্যামল আতিক

প্রকাশিত:
৮ জুলাই ২০২৩, ২১:৩৫


স্কুল শুরুর সময় নির্যাতনের অনেকগুলো নমুনার একটি। সকাল সাতটায় স্কুল হলে, ভোর ছয়টার মধ্যে জাগতেই হয়। এরপর শিশুর পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় বইখাতার ভারী বোঝা, যে শিশু প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তাকে কেন আট-দশটি বই পড়তে হবে?

সকালে ঢাকা শহরের যে কোনো স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়ালে কিছু দৃশ্য আপনি প্রত্যক্ষ করবেন। ঘুম ঘুম চোখে কিছু শিশু স্কুলে ঢুকছে, কিছু শিশু গাড়ির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিছু শিশু স্কুলে যেতে চাচ্ছে না, কিছু শিশু কান্নাকাটি করছে, কিছু শিশু পেট ব্যথা বা মাথা ব্যথার কথা বলছে ইত্যাদি আরো অনেক কিছু। মোটামুটি সব স্কুলের চিত্র একই। এর মানে হচ্ছে, শিশুদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে।

কেন এ বিষয়গুলো ঘটছে, আমরা কি তা কখনোও ভেবে দেখছি? এর মূল কারণ হচ্ছে স্কুল নামক জায়গাটি শিশুদের কাছে মোটেও পছন্দের নয়। অনেক উন্নত দেশ যেখানে প্রাইমারি স্কুলগুলোকে আনন্দের জায়গায় পরিণত করেছে, সেখানে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে জেলখানায়। নির্যাতন কেন্দ্র বললেও ভুল হবে না। এবার দেখা যাক, কীভাবে আমরা স্কুলিংয়ের নামে শিশুদের উপর নির্যাতন করে চলেছি।

শিশুর বয়স তিন থেকে চার হলেই মা-বাবার চিন্তার অন্ত নেই। যেভাবেই হোক ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। না পারলে, স্ট্যাটাস বলে আর কিছু থাকবে না। যে সময়ে শিশুর প্রয়োজন নিরাপত্তা ভালোবাসা আর আনন্দময় পরিবেশ, সে সময়ে শিশুকে প্রস্তুত করা হচ্ছে যুদ্ধের জন্য, কঠিন ভর্তি যুদ্ধ।

এর ফলাফল খুব ভয়ঙ্কর। যদি কোনো কারণে শিশু স্কুলে ভর্তি হতে না পারে তাহলে মা-বাবা আশাহত হন। শিশুকে কিছু না বললেও সে এই ব্যাপারটি বুঝতে পারে। অনেক অভিভাবক শিশুকে তিরস্কার করেন, এমনকি মারধরও করেন। যা শিশুকে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত দেয়, সে নিজেকে অযোগ্য ভাবতে শুরু করে। শিক্ষাজীবনের শুরুতে এভাবেই অভিভাবকরা শিশুর মধ্যে হীনমন্ম্যতার বীজ বপন করে দেয়।

এবার আসি স্কুল ক্যাম্পাস নিয়ে। আগে খেলার মাঠ ছাড়া স্কুলের কথা চিন্তাই করা যেতো না। ক্লাসের ফাকেঁ দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা আর হৈ-হুল্লোড় করে শিশুরা আনন্দ পেত। এখন স্কুল মানে বহুতল ভবন, এসি রুম। খোলা মাঠ তো দূরের কথা, আকাশ দেখারও সুযোগ নেই। অথচ শিশুর শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্যে খোলা মাঠ ও খেলাধুলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খেলাধূলার মাধ্যমে শিশুর কল্পনাশক্তি, পেশি সঞ্চালন দক্ষতা, পারস্পারিক যোগাযোগ, সৃজনশীলতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, সামাজিক অভিযোজন, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি যোগ্যতা বিকশিত হয়। খেলার মাঠ নেই মানে, এই দক্ষতাগুলোর বিকাশ ব্যাহত হওয়া।

স্কুল শুরুর সময় নির্যাতনের অনেকগুলো নমুনার একটি। ঢাকা শহরে তো বটেই, ঢাকার বাইরেও রাত ১২ টার আগে কোনো শিশু ঘুমায় কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সকাল সাতটায় স্কুল হলে, ভোর ছয়টার মধ্যে জাগতেই হয়। এরপর শিশুর পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় বইখাতার ভারী বোঝা; যে শিশু প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তাকে কেন আট-দশটি বই পড়তে হবে?


আমরা জানি প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য কমপক্ষে নয় ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম জরুরি। সেখানে প্রতিদিন গড়ে তিন ঘণ্টা করে কম ঘুমানোর ফলে, শিশুর মনোদৈহিক জীবনে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মনোযোগহীনতা, পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহ, ক্ষুধামন্দা, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ঝিমিয়ে পড়া ইত্যাদি তার প্রাথমিক লক্ষণ। বইখাতার ভারী বোঝা —নির্যাতনের আরেকটি দৃষ্টান্ত। প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের আট থেকে দশটি বই পড়িয়ে আমরা আসলে শিশুকে কী বানাতে চাচ্ছি? উন্নত বিশ্বের স্কুলগুলোতে প্রাইমারি পর্যায়ে নৈতিকতা, সামাজিক শিষ্টাচার ও দায়িত্ববোধ শেখানোর উপর জোর দেয়া হয়। পড়াশোনা শেখানো হয় আস্তে আস্তে, তাও খেলাচ্ছলে আনন্দদানের মাধ্যমে। অথচ আমরা করছি ঠিক উল্টো কাজটি। কাঁধে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে, শিশুকে পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহী করে তুলেছি।

নির্যাতনের আরেক নাম হোমওয়ার্ক। পাঠ্য বই যদি বেশি হয়, স্বাভাবিকভাবেই ক্লাস বেশি হবে, হোমওয়ার্ক বেশি হবে। বাসায় মা-বাবাও হোমওয়ার্ক করার জন্যে শিশুর সঙ্গে চাপাচাপি করেন, যা শিশুকে অতিষ্ঠ করে তুলে। প্রতিদিন হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করলে শিশুর মধ্যে দায়িত্ববোধ ও পড়াশোনার অভ্যাস তৈরি হয় বটে, কিন্তু অত্যধিক হোমওয়ার্কের ফলে শিশুর খেলাধূলা ও আনন্দ বিঘ্নিত হয়। তাই কোন ক্লাসে কতটুকু হোমওয়ার্ক দেয়া হবে, তারও একটি সীমা থাকা উচিত।

পড়াশোনা পদ্ধতি, অত্যাচারের আরেক রূপ। মুখস্ত করা আর তোতা পাখির মতো শিক্ষকের সামনে বলতে পারা অথবা খাতায় ঠিক মতো বমি করা—এই কাজগুলো যে ঠিকঠাক করতে পারবে, সেই ভালো ছাত্র। এতে শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়েই খুশি। কিন্তু শিশু কতটুকু বুঝলো, কতটুকু শিখলো—তা নিয়ে শিক্ষক কিংবা অভিভাবক কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে।

পরীক্ষাভীতি হচ্ছে আরেকটি সমস্যা। পরীক্ষাভীতির কারণে অনেক শিশু আগের রাতে ঘুমাতে পারে না, পাতলা পায়খানা হয়, হাত ও পায়ের তালু ঘেমে যায়, অস্থিরতা বেড়ে যায়, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। সমস্যা আরো প্রকট হয়, যখন অভিভাকরা পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করেন। ফলাফল নিয়ে অযাচিত প্রত্যাশার কারণে শিশু বাড়তি চাপ অনুভব করে, একারণেই পরীক্ষাভীতির এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।


অভিভাবকরা শিশুকে ক্লাসে প্রথম হিসেবে দেখতে চায়, যা শিশুকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে প্ররোচিত করে। পরীক্ষার ফলাফলকেই শিশুর মেধার মানদণ্ড হিসেবে ধরে নেয়। কোনো কারণে যদি ফলাফল খারাপ হয়, শিশু ভাবতে শিখে—সে মেধাধী নয়। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ভাবনা শিশু মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়। তখন পড়াশোনা ছাড়াও মেধা বিকাশের যে আরো অনেক ক্ষেত্র আছে, তা শিশু উপলব্ধি করতে শেখে না।

তাই পরীক্ষা পদ্ধতি ও মেধা মূল্যায়নের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সরকার কিছু নির্দিষ্ট ক্লাস পর্যন্ত পরীক্ষা পদ্ধতি ও মূল্যায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু ইতিবাচক নির্দেশনা দিয়েছেন। এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এই নির্দেশনাগুলো মেনে চলছেন কিনা, এটা মনিটরিং করাও জরুরি। বাস্তবতা হচ্ছে আনুষ্ঠানিক কোনো পরীক্ষা না হলেও ক্লাস টেস্ট, সাময়িক পরীক্ষা ইত্যাদি নানা নামে কোনো কোনো স্কুল কর্তৃপক্ষ ঠিকই পরীক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে অভিভাবকদেরও সায় আছে।

শিক্ষক ও অভিভাবকদের একাংশের যুক্তি, পরীক্ষা না থাকলে শিশু পড়াশোনা করে না, কিছুই শিখতে চায় না। তাদের বক্তব্যে ভুল নেই। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের স্কুলগুলোতে কীভাবে শেখানো হচ্ছে, তা আমাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাসেই সবকিছু শেখানোর চেষ্টা করা হয়, বাসায় পড়াশোনা বা হোমওয়ার্ক দেয়া হয় না। শেখানোর পুরো কাজটিই করা হয় খেলাচ্ছলে, গল্প বলে এবং নানা ধরনের আনন্দ উপকরণের মধ্য দিয়ে। শিশু মনে করে সে খেলাধুলা করছে, আসলে তাকে যে শেখানো হচ্ছে এটাই সে বুঝতে পারে না।

এছাড়াও নীরবে-নিভৃতে আরো অনেক নির্যাতন চলে, যা আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কখনো মানসিক নির্যাতন, কখনো শারীরিক প্রহার, কখনো যৌন নির্যাতন­— এসব খবর আমরা প্রায়শই শুনতে পাই। এ ধরনের নির্যাতনের কারণে শিশুদের সম্ভাবনা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা আমরা বুঝতেই পারছি না। একটি হচ্ছে দৃশ্যমান বাহ্যিক ক্ষতি, যা শিশুর মধ্যে রাগ ক্ষোভ অবাধ্যতা সহিংসতা ইত্যাদি রূপে দেখা দেয়। আরেকটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ক্ষতি, যা শিশুর মধ্যে হতাশা, হীনম্মন্যতা, অভিমান, আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে। এই ক্ষতি দৃশ্যমান বাহ্যিক ক্ষতির তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক।

সবকিছু মিলিয়ে শিশুরা মনে করছে স্কুল আনন্দের কোনো জায়গা নয়, এটা হচ্ছে জেলখানা অথবা নির্যাতন কেন্দ্র। এ কারণেই তারা স্কুলে যেতে চায় না, বমি করে, পেট ব্যথা অথবা মাথা ব্যথার কথা বলে, ঘুমিয়ে পড়ে, কান্নাকাটি করে, ঝিমিয়ে পড়ে ইত্যাদি যত সমস্যা। যদি কেউ প্রমাণ দেখতে চান, তা খুব সহজে পাবেন। ধরুন আপনার শিশু স্কুলের যাওয়ার আগে বমি করছে অথবা পেট ব্যথার কথা বলেছে। যখনই বলবেন আজ স্কুলে যেতে হবে না, দেখবেন এই সমস্যাগুলো আর নেই। যার মানে হচ্ছে স্কুলের প্রতি অনীহা বা ভীতি তৈরি হয়েছে।

তাই উল্লেখিত সব ধরনের নির্যাতন রোধে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে, শিশুদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কোনো ভাবে শিশুর শৈশব যদি নষ্ট হয়ে যায়, এই শিশু পরিবার ও সমাজের প্রতি প্রতিশোধ নেবেই। কারণ শৈশবের আনন্দায়ক স্মৃতিই শিশুকে সুস্থ মানসিক গঠনে বড় করে তুলে। ক্রমাগত নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যে শিশুরা বড় হচ্ছে, তারাও বড় হয়ে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায় না। একটি প্রজন্ম মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বেড়ে উঠলে, তার নেচিবাচক প্রভাব পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মে।

এই দুষ্টচক্র থেকে রক্ষা পেতে, পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই, নিশ্চিত করতে হবে স্কুল যেন না হয় নির্যাতন কেন্দ্র, তা করা না গেলে বিপর্যয় অনিবার্য।


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর