প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২৪, ১৫:৪৮
সড়কপথে ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর তেমন উদ্যোগ নেই। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো যানজটপ্রবণ ১৫৫টি স্পট চিহ্নিত করেছে। চিহ্নিত স্থানগুলোতে কীভাবে যানজট নিরসন করা হবে সে বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট পথ নকশা ঘোষণা হয়নি।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সেতু, ফ্লাইওভার ও সড়কে টোল ফ্রিসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
যানজট নিরসনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টিও স্বক্রিয় বিবেচনায় নেই। জনপ্রতিনিধি বা তার লোকজন এ কাজে অংশ নিতে চাইলে কেউ বাধা দিবে না-বিষয়টি এ অবস্থায় রাখা হয়েছে।
এসবের বাইরে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে নতুন কোনো উদ্যোগও নেই। ফলে প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ আনন্দযাত্রা দুর্ভোগের মধ্য দিয়েই শেষ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে ঈদ আনন্দ যাত্রায় দুর্ভোগ বাড়ায় যানজট। এর অনেকগুলো কারণ আছে। মহাসড়কে নিয়মিত বাসের বাইরে, ফিটনেসহীন বাস, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার এবং বাইক ঈদের সময় যাত্রী বহন করে।
বেশিরভাগ সময় ফিটনেসহীন বাসগুলো যাত্রী নেওয়ার জন্য মহাসড়কের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকে। যাতে পেছনের কোনো বাস তা অতিক্রম করে যাত্রী নিতে না পারে। এতে পেছনের যানবহনগুলোর গতি শ্লথ হয়ে যায়। যানজটের শুরু এখান থেকেই। এটা ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে।
এছাড়া ট্রাক, পিকআপে চুক্তিতে যাত্রী তোলা হয়। দীর্ঘ যাত্রায় প্রায় সময়ই পিকআপগুলো মহাসড়কে বিকল হয়ে পড়ে। যাত্রীসমেত বাহনটি মহাসড়ক থেকে সরানো যায় না বা পেছন থেকে ক্রেন গিয়ে পিকআটটি রাস্তা থেকে তুলে আনবে সে সুযোগও প্রায় থাকে না বললেই চলে। এখান থেকেও শুরু হয় দুর্বিষহ যানজট।
অনভিজ্ঞ চালকের হাতে মাইক্রোবাস বা মিনিবাস দ্রুত গতিতে চলতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। এতে মানুষের প্রাণ ও সম্পদহানিসহ যানজট তৈরি করছে। এছাড়া সেতু, ফ্লাইওভার ও সড়কে ম্যানুয়াল পদ্ধতির টোল আদায়ের ফলেও যানজটের সৃষ্টি হয়।
গত ২১ মার্চ রাজধানীর বনানীস্থ বিআরটি অফিসে আন্তঃসংস্থার সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে বিভিন্ন পরামর্শ আসে। সেসব পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।
ওই সভায় সাবেক নৌ-পরিবহণমন্ত্রী মো. শাহজাহান খান পরামর্শ দিয়েছিলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে হানিফ ফ্লাইওভার, বঙ্গবন্ধু সেতুসহ সব সেতু, ফ্লাইওভার ও সড়কের টোল ফ্রি করে দেওয়া।
এই কদিনের টাকা সরকার ভুর্তকি দেবে। তাহলে যানজট অনেকাংশে লাঘব হবে। ওই সভায় পুলিশের পক্ষ থেকে সড়ক, সেতু ও ফ্লাইওভারে টোল ফ্রি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঈদের ছুটি বাড়ানোরও পরামর্শ আসে। অন্যদিকে যাত্রীকল্যাণ সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে ঈদের আগে ছুটি দুদিন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।
কিন্তু এসব পরামর্শ ও দাবি বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টরা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হলে আসন্ন ঈদযাত্রা অনেকাংশে নির্বিঘ্ন করার সুযোগ রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে নিত্যদিনই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। কার্যকর পদক্ষেপ ও তৎপরতা না বাড়ালে ঈদযাত্রায় তা বেড়ে তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
আসন্ন ঈদুল ফিতরের যাত্রায় এই মহাসড়কের অন্তত ১৫টি স্পটে ভয়াবহ যানজট হতে পারে। এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন সিলেট, ভৈরব, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় শত শত দূরপাল্লার গণপরিবহণ চলাচল করে। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, অবৈধ বাসস্ট্যান্ড, নিয়ম অমান্য করে গাড়ি চালানোর কারণে সমস্যা বাড়ছে।
তথ্যানুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ৬টি পয়েন্টে এবার ঈদে যানজটের শঙ্কা করা হচ্ছে। এসব স্পটে এবার বাড়ি ফেরা মানুষ ভোগান্তিতে পড়তে পারেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর বাজার বাসস্ট্যান্ড, হোতাপাড়া বাসস্ট্যান্ড, বাঘের বাজার বাসস্ট্যান্ড, শ্রীপুরের মাস্টারবাড়ী বাজার, সিডস্টোর বাজার ও ময়মনসিংহের ভালুকা বাসস্ট্যান্ড। আর ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা থিমোড় এলাকা।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক কাজ চলছে। পাশাপাশি যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো নামানো করানোর কারণেও এখনো যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া ঈদযাত্রায় কালিহাতীর এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড় পর্যন্ত যানজট হতে পারে।
স্বাভাবিক সময়ে এই সড়কে ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চললেও ঈদযাত্রায় গতি ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটারে নেমে আসে। এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানজট বাড়তে পারে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে দৈনিক ১৮ থেকে ২০ হাজার যানবাহন পারাপার হয়; তবে ঈদযাত্রার সময় এটা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ২০ পয়েন্টে যানজটের শঙ্কা রয়েছে।
ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে দাউনকান্দি টোল প্লাজা থেকে ফেনীর মোহাম্মদ আলী পর্যন্ত ১০৩ কিলোমিটার মহাসড়কে যানজট নিরসনে হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশের একাধিক ইউনিট এবং কমিউনিটি পুলিশ কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ভাঙাচোরা ও সরু সড়ক, সড়ক সম্প্রসারণ ও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ বাড়তে পারে। এ ছাড়া সেতু ও সড়কের ধীরগতিতে টোল আদায়, সড়কে গাড়ি অকেজো হয়ে পড়া, একত্রে অনেক মানুষ সড়কে নেমে পড়ায় সড়কের ঈদযাত্রায় যানজট হচ্ছে।
পাশাপাশি এ বছর ১২ মার্চ রোজা শুরু হয়েছে। আর পবিত্র ঈদুল ফিতর নির্ভর করে চাঁদ দেখার ওপর। তবুও ইতোমধ্যে ঈদের জন্য ১০, ১১ ও ১২ এপ্রিল সম্ভাব্য ছুটির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে সরকার অটল থাকলে এবং ২৯ রোজা হলে ঈদের আগের দিনও অফিস খোলা থাকবে। সেটা হলে ভোগান্তির মাত্রা অনেকাংশে বাড়বে।
তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ৮ ও ৯ এপ্রিল নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা করার বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানায়, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে ১৫৫টি যানজট স্পট চিহ্নিত করেছে। সেসব স্পটের যানজট নিরসনে সড়ক বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা দরকার। তাহলে ঈদে বাড়িফেরা মানুষের ভোগান্তি লাঘব হবে।
সরকারের চিহ্নিত স্পটের মধ্যে রয়েছে-ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৪৮টি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে ৫২টি, ঢাকা সিলেট মহাসড়কে ৪১টি, ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কে ৮টি এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ৬টি। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছেন, সড়ক ও মহাসড়কে যানজট স্পট রয়েছে ৭১৪টি।
আসন্ন ঈদুল ফিতরে বাড়ি ফেরায় সড়কপথের যানজট দুর্ভোগ বিষয়ে জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এবার ঈদুল ফিতরের ঈদযাত্রায় নির্বিঘ্ন হবে না। সড়ক মহাসড়কের যানজট স্পটগুলোয় কার্যকর তৎপরতা নেই।
পাশাপাশি ঈদের আগে ছুটি বাড়ানোসহ কিছু পরামর্শ এসেছিল। সরকারের সংশ্লিষ্টরা সেসব আমলে নিচ্ছে না। এতে বোঝা যায় ঈদযাত্রার দুর্ভোগ লাগবে সরকার আন্তরিক নয়।
এই বিষয়ে সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লা নুরী যুগান্তরকে বলেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়ক বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করছে। আর এসব কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও সম্পৃক্ত রয়েছেন।
এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশ, বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা সড়কের যানজট নিরসনে মাঠে নিয়োজিত থাকছে।
তিনি বলেন, সড়ক, সেতু ও ফ্লাইওভারের টোল ফ্রি করার পরামর্শ এসেছে। যেটা সরকার বিবেচনা করতে পারেনি। এটা করার ভালো-মন্দ এবং বাস্তবতাও রয়েছে। তবে আমি বলব পরিবহণ মালিকরা ইলেক্ট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) পদ্ধতির আওতায় এলে টোলবুথে যানজটের কোনো কারণ নেই।
কিন্তু পরিবহণ মালিকরা সেসব দিকে মনোযোগী নয়। ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকদেরও এই আওতায় আসতে হবে। তাহলে টোলবুথের কারণে যানজট হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।
মন্তব্য করুন: