প্রকাশিত:
৪ মার্চ ২০২৪, ১৬:২৫
সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়েটি সেদিন মায়ের ফেরার অপেক্ষায় ছিল। মা গিয়েছিলেন বগুড়ায় একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। রাতে ফেরার কথা ছিল। শিশুটির মা সেদিন ফিরেছিলেন। তবে নিথর দেহে। শিশুটি তখনো বুঝে উঠতে পারেনি যে তাঁর মা আর কখনোই ফিরবেন না। আদর করবেন না। মেয়েকে নিয়ে খেলবেন না। তখনো সে বুঝতে পারেনি যে মা ছাড়া জীবনটা দিন দিন কতটা অচেনা হয়ে উঠতে পারে। একাকী সংগ্রাম করতে হবে। মা ছাড়া সেই সংগ্রাম এখনো চলছে ছোট পর্দার অভিনেত্রী রিমু রোজা খন্দকারের। তিনি জানান, মা ছাড়া জীবনটা যেন ভুলে ভরা। এই রিমু আশির দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী টিনা খানের মেয়ে, যাঁর নামেই একসময় সিনেমা হয়েছিল ‘প্রিন্সেস টিনা খান’।
মাকে হারানোর পর ছোট্ট মনটাকে গ্রাস করে নিঃসঙ্গতা। সেই নিঃসঙ্গতা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন রিমু; কখনো অভিনয়ে কখনো ব্যক্তিজীবনে। এসব যেন এখন সয়ে গেছে। জীবনের প্রতি বিরক্ত হয়ে একসময় মায়ের পথেই অভিনয়ে নাম লেখান রিমু। কিন্তু পথটা দিন দিন কঠিন হয়ে ওঠে। এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন অভিনেত্রী হিসেবে নিয়মিত কাজ করে যেতে। এখানেও বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়।
রিমু বলেন, ‘আমার অভিনয়ের শুরুতে “এফএনএফ”, “হাউসফুল”, “একটা কিনলে একটা ফ্রি”, “আরমান ভাই”সহ অনেক ভালো ভালো নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছি। গুণী নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। দর্শক আমাকে চিনেছেন।
আমিও চেয়েছি একজন চরিত্র–অভিনেত্রী হয়ে উঠতে। কখনো চাইনি নায়িকা হতে। চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে অভিনয় করে কী পাচ্ছি? এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তারপরও প্রায়ই নানা অজুহাতে শুটিং থেকে বাদ দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে আমার সঙ্গে।’
রিমু জানান, বাদ যাওয়ার কারণ হিসেবে রয়েছে মিডিয়ার পলিটিকস। তবে দমে যাওয়ার পাত্রী নন তিনি। তারপরও কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকতে হলে আমাকে শুটিং করতে হবে। কিছু মানুষ পছন্দ করবেন না স্বাভাবিক। আবার অনেকেই একের পর এক অভিনয়ের জন্য ডাকছেন। তাঁরা আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু একটা চরিত্রের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর “না” শুনলে খারাপ লাগে। কারণ, এটা কোনো পেশাদার আচরণ নয়। যেমন আগে ক্যারিয়ার শুরুর দিকে অনেকেই আমার কণ্ঠের দোহাই দিতেন। তারপরও তো তখন কাজ করেছি। কিন্তু এখন শুনতে হচ্ছে, আমার কণ্ঠ নাকি ভালো। যেটা অনেক চরিত্রের সঙ্গে যায়। কিন্তু নিজেদের মধ্যে পলিটিকসের কারণে ক্যারিয়ারে আরও ভালো জায়গায় থাকতে পারিনি।’ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে এমন অনেক বিষয় নিয়েই আক্ষেপ রয়েছে রিমুর।
মাকে হারানোর পর কিশোরী বয়সে বাবাকেও হারান রিমু। তার পর থেকে একাই বড় হয়েছেন। জীবন কীভাবে চালাবেন, কী করবেন সেগুলো নিয়ে কারও কাছ থেকে সেই অর্থে পরামর্শ পাননি। মা মারা যাওয়ার পর শৈশবে কেটেছে ভারতেশ্বরী হোমসে। পরে নিজের মতো করেই থাকতেন। পরিবারের ছোঁয়া কখনোই পাননি। অভিনয় শুরুর পর সহকর্মীদের পেয়েছেন পরিবার হিসেবে। সহকর্মীদের কাছ থেকেই নানা উপদেশ পেয়েছেন। কিন্তু তত দিনে একের পর এক ভুল জীবনকে নড়বড়ে করে তুলেছিল।
ভুলগুলো কী ছিল জানতে চাইলে রিমু বলেন, ‘আমি কলেজে পড়ার সময় একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। দুজনের সম্পর্কটাও ভালো ছিল। আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল। পরে সেই ছেলে একদিন জানায়, চিত্রনায়িকার মেয়েকে নাকি তার পরিবার মেনে নেবে না। এতে নাকি তাদের সম্মানের হানি হবে। তারপর আর আমাদের সম্পর্ক বেশিদূর এগোয়নি। তা ছাড়া আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতাম। কখন কী করা দরকার, সেগুলো কারও কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারতাম না।’
প্রেমে বিচ্ছেদের পর রিমু চেয়েছিলেন বিমানবালা হতে। ক্যারিয়ার নিয়েই ছিল তাঁর যত মনোযোগ। যে এজেন্সির মাধ্যমে বিমানবালার কাজ করতে চান, সেই এজেন্সি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় তাঁদের কিছু ছবি তুলে রাখেন ইকবাল আহমেদ নামের একজন। সেই ছবি দিয়ে ২০০৮ সালে শুরু হয় মডেলিং ও অভিনয়ের যাত্রা। অভিনয়টা তখন ভালোই চলছিল। তিন বছরের মধ্যে পরিচিতিও বাড়ছিল। এর মধ্যেই ছয় মাসের সম্পর্কে একজনকে বিয়ে করেন তিনি।
‘এই বিয়ে ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় বড় ভুল। আমি ভুল মানুষকে বিয়ে করেছিলাম। তাঁর মিষ্টি কথায়, তাঁকে বিয়ে করি। পরে দেখি, সে নেশা করে। একসময় সে আমার গয়না ও মূল্যবান সবকিছু নিয়ে পালায়। তার পর থেকে প্রেম–বিয়ের মধ্যে আমি নেই, একাই থাকতে চাই। জীবনে আর ভুল করতে চাই না। কারণ, আমার জীবনটাই ভুলে ভরা,’ বলেন রিমু।
রিমু জানান, সম্প্রতি একটা ভুলের জন্য সহকর্মী ও প্রযোজকদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছেন তিনি। কয়েক দিন আগে তিনি অভিনেত্রী সামিরা খান মাহির একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেই ভিডিওতে লেখেন, ‘বলেন, তিনি কে?’ সেই ভিডিও কেউ কেউ এডিট করলে অনেকে রিমুর ওপর চটে যান। রিমু বলেন, ‘ন্যাচারালি মাহিকে অনেক সুন্দর লাগছিল। একটি বাচ্চাসহ হাঁটছে। পরে মনে হলো, তাঁর ভিডিও করি। সেটাই পোস্ট করার পর অনেকেই উল্টাপাল্টা মন্তব্য করেন। সেটার দোষ আমার ওপর পড়ে। পরে মাহিকে কেন এভাবে ভিডিও করলাম, আমাকে দেখে নেবেন... ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আমাকে হুমকি দিতে থাকেন কয়েকজন প্রযোজক।’
রিমু আরও বলেন, ‘মাহির সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। লাইভ করেও ক্ষমা চেয়েছি। এখন এমন অবস্থা যে এ ঘটনায় আমাকে ভুল বুঝছেন অনেকেই। আমার ক্যারিয়ার নাকি শেষ করে দেবেন, এটাও বলছেন। কেন এগুলো আমাকে বলছেন, জানি না। আমি এখনো বলছি, মাহির কোনো ক্ষতি হোক, তা চাইনি। আমাদের সম্পর্কটাও ভালো।’
দুঃখ প্রকাশ করে রিমু জানান, তাঁর বিপদে অনেক সহকর্মী এগিয়ে আসেন না। তবে নিলয় আলমগীর, পরিচালক মহিন খান, সাগর জাহানসহ আরও অনেকে তাঁকে সব সময় সাহায্য করেন ও পরামর্শ দেন। মায়ের কথা স্মরণ করে রিমু বলেন, ‘মনে হয় মা বেঁচে থাকলে জীবনে এত ভুল করতাম না। মা হয়তো আমাকে আগলে রাখত। কোনো পরামর্শ নিতে চাইলে মা-ই সাহায্য করত। জীবনটাও এমন হতো না। এখনো মন খারাপ হলে মায়ের সহকর্মীদের কাছ থেকে মায়ের গল্পগুলো শুনি।’
রিমুর মা প্রিন্সেস টিনা খান ১৯৮৯ সালে দুর্ঘটনায় মারা যান। সেদিন তিনি পরিচালক আবু সাইয়ীদের ‘আবর্তন’ নামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের উদ্বোধন করতেই আলমগীর কবিরের সঙ্গে বগুড়ায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে আরও ছিলেন মোরশেদুল ইসলাম ও মুনিরা মোরশেদ মুন্নী। ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ করে ফেরার পথে ফেরিঘাটে এক ঘাতক ট্রাকের আঘাতে তাঁদের বহন করা গাড়িটি যমুনা নদীতে পড়ে যায়। এতে মৃত্যু হয় টিনা খান ও আলমগীর কবিরের। অন্যরা রক্ষা পান।
প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম অভিনেত্রী টিনা খানকে সিনেমায় আনেন। সুযোগ দেন ‘বিমানবালা’ সিনেমায় অভিনয় করার। প্রায় ২৫টি বাণিজ্যিক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। জানা যায়, নায়িকা নামের চেয়ে অভিনয়শিল্পী হিসেবে পরিচয় তিনি বেশি পছন্দ করতেন। ‘রজনীগন্ধা’, ‘মৌ চোর’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘লাগাম’, ‘দুই জীবন’, ‘এরই নাম প্রেম’ ‘একাই একশো’সহ অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। শেষে রিমু বলেন, ‘মা শেষবার ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় আমার কপালে চুমু দিয়েছিলেন। সেই চুমু যেন এখনো আমার কপালে লেগে আছে। মা মারা যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম মায়ের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে। সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম। এখনো একা থাকলে মায়ের জন্য ভীষণ কান্না পায়।’
মন্তব্য করুন: