সোমবার, ২৫শে নভেম্বর ২০২৪, ১১ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ই-পেপার
ব্রেকিং নিউজ:
  • সারাদেশে জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করা হচ্ছে। আগ্রহী হলে আপনার সিভি ই-মেইল করতে পারেন। ই-মেইল daajkaal@gmail.com
সংবাদ শিরোনাম:
  • ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগ করা হবে
  • আবারও যাত্রাবাড়ী মোড় অবরোধ ব্যাটারি রিকশাচালকদের
  • অক্টোবরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৭৫ জন নিহত
  • বোয়ালখালীতে আগুনে ৫ বসতঘর পুড়ে ছাই
  • ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কেলি রদ্রিগেজ
  • প্রথমবার সচিবালয়ে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
  • এস আলমের ঋণ জালিয়াতি, কেন্দ্রিয় ব্যাংকের ১৩ জনকে তলব
  • সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা
  • ড. ইউনূসের ভিশনের দিকে তাকিয়ে যুক্তরাজ্য: ক্যাথরিন ওয়েস্ট
  • ২০২৫ সালে সরকারি নির্মাণে পোড়া ইট ব্যবহার বন্ধ হবে

ব্যর্থতার দায় আসছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর

ডেস্ক রির্পোট

প্রকাশিত:
২৫ জানুয়ারী ২০২৪, ১৫:১৯

সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনে ব্যর্থতার পর বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশের মধ্যে এখন মোটা দাগে দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। একটি হচ্ছে, নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল বা বর্তমান বাস্তবতায় গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব কি না। অন্যটি হচ্ছে, বিএনপির প্রধান নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বের সক্ষমতা ও দেশ-বিদেশে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেশে-বিদেশে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি বেশি আলোচিত। দলটির অনেকে মনে করেন, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বা প্রভাবশালী মহলের মধ্যে তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাঁর প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাব ইতিবাচক নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোও তাঁর ব্যাপারে কতটা ইতিবাচক, সেই প্রশ্নেও আলোচনা রয়েছে দলটিতে।

খালেদা জিয়া অসুস্থ। দলের প্রধান নেতা তারেক রহমানও দেশে নেই। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দল পরিচালনা করছেন। তাঁর নির্দেশনামতোই আন্দোলন-কর্মসূচি সংঘটিত হয়।

সরকারের দিক থেকে নানা চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বিএনপি ভাঙেনি। তবে আন্দোলনে ব্যর্থতা নেতাদের পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়েছে। বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবরের পর দলে তিন ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ অনেক নেতা-কর্মী কারাবন্দী হন। কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের বড় অংশটি আত্মগোপনে যায়। রুহুল কবির রিজভীসহ অল্পসংখ্যক নেতা-কর্মীকে প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে দেখা যায়।


এ পরিস্থিতিতে বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবী, যুগপৎ আন্দোলনরত জোটের নেতা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, দলের ভেতরকার দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে এবং বাইরের ঝুঁকিগুলো সামলে আগামী দিনে রাজনৈতিক সুযোগগুলো বিএনপি কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করছে দলটির ভবিষ্যৎ।

বিএনপির নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, বিরোধী দলের আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ না পাওয়ার আরেকটি কারণ মানুষের রাজনীতিবিমুখ মনোভাব। জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও তাদের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিএনপি তার জনসমর্থন দেখাতে সমর্থ হলেও সফলতা দেখাতে পারেনি। এর বড় কারণ নেতৃত্বের দুর্বলতা। বিএনপির মূল নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত হওয়ায় তিনি নিজ বাসায় রয়েছেন। বয়স ও অসুস্থতার কারণে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। তাঁর অবর্তমানে দলের প্রধান নেতা তারেক রহমানও দেশে নেই। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দল পরিচালনা করছেন। তাঁর নির্দেশনামতোই আন্দোলন-কর্মসূচি সংঘটিত হয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, বিএনপির প্রধান দুই নেতার অনুপস্থিতিতে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নেতৃত্বের দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হননি। আবার এটাও সত্য যে দলের সব সিদ্ধান্তের জন্য তারেক রহমানের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, বিরোধী দলের আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ না পাওয়ার আরেকটি কারণ মানুষের রাজনীতিবিমুখ মনোভাব। জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ থাকলেও তাদের সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি।

১৫ বছর ধরে আমাদের আন্দোলন চলছে। আন্দোলনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। মাঝে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে সারা দেশে দলকে পুনর্গঠন করেন তারেক রহমান। আশা করি, দল এর ফল পাবে। হয়তো আরও কিছুটা কষ্ট করতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত আন্দোলন-কর্মসূচিতে শুধু বিএনপির সক্রিয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের দেখা গেছে। বিএনপির নেতারা নানা কর্মসূচিতে জনগণকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানালেও তেমন সাড়া পাননি। নেতৃত্বের দুর্বলতা বা নেতৃত্বের প্রতি আস্থা না থাকা এর কারণ বলে মনে করছেন অনেকে। নেতৃত্বের এই দুর্বলতা না কাটলে ভবিষ্যতে দলের জন্য তা বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ  বলেন, বিএনপির প্ল্যান ‘এ’ যদি নির্বাচন বর্জন হয়, তাহলে প্ল্যান ‘বি’ কী ছিল। সেটা মনে হয় তারা এখন পর্যন্ত জানে না। বড় আন্দোলনে এ বিষয়গুলো খুব জরুরি। আর লিডারশিপ (নেতৃত্ব) শুধু একজন বা দুজনের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এটা শুধু কেন্দ্রীয় নয়, সর্বক্ষেত্রে। সংগঠনকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। শ্রমিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী—বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।


নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া। তাঁর নেতৃত্বে দল তিনবার ক্ষমতায় আসে। দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে তারেক রহমান অনেকটা একক নেতৃত্বে দল চালাচ্ছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে সাংগঠনিক, নীতিনির্ধারণী ও রাজনৈতিক কর্মসূচি—সবকিছুই তিনি দেখেন।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার পর তারেক রহমান বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো অনেকটাই বদলে ফেলেছেন। তিনি গত কয়েক বছরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনেন। সব মহানগরে পুরোনোদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি করেন; যা অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ছিল না বলে দলে আলোচনা উঠেছিল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, নেতৃত্বের এই পরিবর্তনগুলো বিগত আন্দোলনে কতটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পেরেছে।

কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের ‘ক্লান্তি’, এরপর ভোট শেষে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে ‘হতাশ’ হয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের কী আশা দেখিয়ে সংগঠিত করে আবার মিছিলে আনা হবে, তা নিয়ে নীতিনির্ধারণী নেতারা কিছুটা চিন্তিত।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে আক্ষেপ করে জানান, একসময় মির্জা আব্বাস ও সাদেক হোসেন খোকার মতো ব্যক্তিরা ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব দেন। একইভাবে অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামে আবদুল্লাহ আল নোমান ও মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, রাজশাহীতে মিজানুর রহমান (মিনু), খুলনায় নজরুল ইসলাম (মঞ্জু), সিলেটে আরিফুল হক চৌধুরী, বরিশালে মজিবর রহমান সরোয়ারের মতো নেতারা ছিলেন। এসব জায়গায় এখন যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতা, গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দলের ভেতরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন আছে। শুধু তারেক রহমান বা বিশেষ কারও ‘পছন্দে’ অনেকে নেতৃত্ব পেয়েছেন, যাঁদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতৃত্বের যোগ্যতা ক্রমেই নিচের দিকে নামছে বলে সমালোচনা রয়েছে।

ঢাকার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলের বিএনপির একাধিক নেতা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ২০১৩-১৪ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল, ২০২৩ সালে সেটা তেমন হয়নি। সংগঠন কর্মীহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে। মাঠের বাস্তবতা অনুযায়ী যে নেতৃত্ব আসা উচিত, তা নেই। দিনে দিনে নেতৃত্ব দুর্বল হচ্ছে, যে কারণে প্রতিরোধের আন্দোলন সফল হয়নি।

অবশ্য আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্বের ব্যর্থতা বা কৌশলগত কোনো দুর্বলতা আছে বলে মনে করেন না দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি  বলেন, সরকার বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের যত যন্ত্র আছে, তার সব নির্বিচার ব্যবহার করেছে। গত দেড় বছরে ৩০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। এর মধ্যেই বিএনপি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

২০০৮ সাল থেকে তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত আছেন। খালেদা জিয়া এখনো মুক্ত নন। সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি হাসপাতালে-বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। দলের প্রধান দুই নেতার অনুপস্থিতিতে বড় নীতিনির্ধারণী প্রশ্নে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে বিএনপিকে দোটানায় থাকতে হয়। নেতৃত্বের এই সংকট আন্দোলনে প্রভাব ফেলে বলে অনেকে মনে করেন।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান  বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আমাদের আন্দোলন চলছে। আন্দোলনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। মাঝে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে সারা দেশে দলকে পুনর্গঠন করেন তারেক রহমান। আশা করি, দল এর ফল পাবে। হয়তো আরও কিছুটা কষ্ট করতে হবে।’


তবে এই অপেক্ষা আর কত দিন—সে প্রশ্ন এখন বিএনপির একেবারে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে। ভোটের পর প্রশ্নটি আরও জোরালো হয়েছে। ভোটের আগে, বিশেষ করে বিএনপির মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের পর রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন ছড়ায় যে বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারেক রহমান তাতে রাজি না হওয়ায় সে তৎপরতা থেমে যায় বলে আলোচনা আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের কেউ কেউ নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন। কিন্তু তারেক রহমান নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে থাকায় বিষয়টি আর এগোয়নি। কারও কারও মতে, তারেক রহমানের এই অবস্থানের কারণ হলো, যে নির্বাচনে তিনি থাকছেন না, সে নির্বাচনে বিএনপি গিয়ে অন্য কেউ নেতা হোন, সেটা তিনি চাননি। তাঁর লক্ষ্য, ২০২৯ সালের সংসদ নির্বাচনে জিতে দেশে ফেরা। আরও একটি কারণ বলা হচ্ছে, বর্তমানে দেশে যে অর্থনৈতিক সংকট এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ‘অরাজক’ পরিস্থিতি বিরাজমান, ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ সরকার তা সামাল দিতে পারবে না। আর ক্ষমতায় এলে বিএনপির পক্ষেও সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। এসব হিসাব-নিকাশ থেকে তারেক রহমান নির্বাচনের ব্যাপারে শুরু থেকেই অনাগ্রহী ছিলেন। তবে এসব বিষয়ে দলের কোনো পর্যায়ের নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, বিএনপির সামনে অনেক ঝুঁকি আসতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। কারণ, নির্বাচনের আগপর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল একরকম। এখন পরিস্থিতি পাল্টাতে পারে। ভোটের আগে নেতা-কর্মীরা পরিবর্তনের আশায় দল ছাড়েননি।

বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতা ও সহিংসতার মামলা রয়েছে। নির্বাচনের আগে থেকে এসব মামলার রায় ঘোষণা শুরু হয়েছে। নেতাদের কারও কারও আশঙ্কা, রায়ে বেশির ভাগ নেতার কারাদণ্ড হলে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হতে পারে। এর জেরে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কেউ কেউ বিদেশেও চলে যেতে পারেন বলে গুঞ্জন আছে।

তবে দলের নেতা এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ এই ঝুঁকির মধ্যে বিএনপির জন্য ভালো সুযোগ ও সম্ভাবনাও দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভোটারদের বড় অংশ ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে সরকারের প্রতি তাদের অসন্তোষ জানিয়ে দিয়েছে। প্রকৃত ভোটের হার ১০-১৫ শতাংশের কম বলে মনে করে বিএনপি। ভোটারদের এই অসন্তোষ বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিএনপি মনে করে, এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে ‘প্রহসন’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সরকারের পক্ষে থাকা দেশগুলোও বার্তা পেয়েছে এ সরকারের জনসমর্থন কোন পর্যায়ে।

‘আজকে দেশে যেটা চলছে, সেটা হলো একটা পেসিভ রেসিস্টেন্সের (নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ) মতো অবস্থা। সে কারণে ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোট দিতে যায়নি। এই পেসিভ রেসিস্টেন্সকে কীভাবে অ্যাকটিভ রেসিস্টেন্সে (সক্রিয় প্রতিরোধ) নিয়ে আসা যায়, সে জন্য কাজ করতে হবে। সেটা একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। জনগণকে পেসিভ থেকে অ্যাকটিভে রূপান্তর করার যে কাজ, সেটাই এখন বিএনপির করণীয় বলে আমি মনে করি।’
মাহবুব উল্লাহ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক

এ ছাড়া ১৪ দলের বাইরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় যেসব রাজনৈতিক দল ভোটে অংশ নিয়েছে, তাদের প্রায় সবাই এখন হতাশায়। জাতীয় পার্টি ভোটে অংশ নিয়ে ভরাডুবির পর দলীয় কোন্দলের মধ্যে পড়েছে। ইতিমধ্যে দলের ভেতর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনে গিয়ে তারা জাতির কাছে ‘বেইমান’ হয়েছে কি না। এসব রাজনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি সামনে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। এতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়াবে। এ বিষয়গুলোকে রাজপথে সরকারবিরোধী বড় মঞ্চ গড়ে তোলার পথ তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন দলটির নেতাদের অনেকেই।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন  বলেন, এবারের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে যায়নি, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দল হিসেবে জাতীয় পার্টির টিকে থাকা কঠিন করে তুলেছে। অন্তত ১০০টি আসনে আওয়ামী লীগে স্থায়ী বিরোধের জন্ম দিয়েছে। ২২-২৩টি ছোট দল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই নির্বাচনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা বিএনপির আগামী দিনের আন্দোলন-রাজনীতির জন্য বড় সুযোগ করে দিয়েছে।

আবার আন্দোলন কীভাবে
বিএনপির সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এখন বিএনপি নিজ দল ও মিত্রদের ঐক্যবদ্ধ রেখে নতুন করে আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে। এ লক্ষ্যে মিত্রদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম, গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সবার সঙ্গে কথা বলে নতুন কর্মসূচি শুরুর চিন্তা করছে বিএনপি। তবে রাস্তার কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে নীতিনির্ধারকেরা দলের মহাসচিবসহ কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।

এখনো বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা আন্দোলনেই আছেন। সরকারের পতন ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের ‘ক্লান্তি’, এরপর ভোট শেষে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে ‘হতাশ’ হয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের কী আশা দেখিয়ে সংগঠিত করে আবার মিছিলে আনা হবে, তা নিয়ে নীতিনির্ধারণী নেতারা কিছুটা চিন্তিত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন করে আন্দোলন গড়তে পরিবর্তনের বাস্তবভিত্তিক কোনো সম্ভাবনা না দেখলে কর্মী-সমর্থকদের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

অবশ্য বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী  বলেন, ‘আমরা যদি উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো দেখি, বিজয়ে এক শ থেকে দেড় শ বছর লেগেছে। আমরা মানুষের ভোটের, গণতন্ত্রের, বাক্‌স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। এ সংগ্রাম দমন-পীড়নে বাধাগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত সংগ্রাম কখনো ম্লান হয়ে যায় না।’

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এবার শুরু থেকেই তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দৃঢ় ছিলেন। এত বাধা, হামলা, মামলার পরেও এখনো তাঁরা শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় রয়েছেন। কোনোরকম সংঘাতে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ পন্থায় তাঁরা জনগণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন, জনগণ তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোট দিতে যায়নি। এ আন্দোলনে এটাই তাঁদের বড় বিজয়।

তৃণমূলের নেতাদের কেউ কেউ দলের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও কর্মপন্থা নিয়ে অস্পষ্টতার কথা বলছেন। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেছেন, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দল কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দলের ভেতরে কোনো আলোচনা নেই, দিকনির্দেশনাও নেই। কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছাড়া এগোলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।

সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তারা (আওয়ামী লীগ) মেগা প্রজেক্ট করেছে, আপনি (বিএনপি) কী করবেন। মানুষকে মিছিলে আনতে হলে আপনার স্বপ্নটা জানাতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট, উন্নয়নে দুর্নীতি, সম্পদের বৈষম্য—এ বিষয়গুলোকে রাজনৈতিকভাবে সামনে আনতে হবে। শুধু নির্বাচনের বাইরে থাকলে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে এখনই কিছু জরুরি সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, বিএনপিসহ সব অঙ্গসংগঠনে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। নেতা নির্বাচন বা মনোনয়নের ক্ষেত্রে কোনো সুবিধার বিষয় যাতে প্রাধান্য না পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। নির্বাচন বর্জনের কৌশল এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। তাই বাস্তবতা মেনে আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। আন্দোলনের স্তর অনুযায়ী নির্বাচন বর্জন অথবা অংশগ্রহণের কৌশল নিতে হবে।

আজকে দেশে যেটা চলছে, সেটা হলো একটা পেসিভ রেসিস্টেন্সের (নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ) মতো অবস্থা। সে কারণে ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোট দিতে যায়নি। এই পেসিভ রেসিস্টেন্সকে কীভাবে অ্যাকটিভ রেসিস্টেন্সে (সক্রিয় প্রতিরোধ) নিয়ে আসা যায়, সে জন্য কাজ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গণ-আন্দোলন বা গণ-অভ্যুত্থান ছাড়া এ ধরনের সরকারকে সরানো বা সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের জন্য জনগণ মানসিকভাবে কতটুকু প্রস্তুত, সে প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, জনগণ বিরোধী দলগুলোর ভোট বর্জনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভোটে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ না করে সরকারের বিরুদ্ধে একধরনের ‘নীরব প্রতিবাদ’ জানিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ  বলেন, ‘আজকে দেশে যেটা চলছে, সেটা হলো একটা পেসিভ রেসিস্টেন্সের (নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ) মতো অবস্থা। সে কারণে ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোট দিতে যায়নি। এই পেসিভ রেসিস্টেন্সকে কীভাবে অ্যাকটিভ রেসিস্টেন্সে (সক্রিয় প্রতিরোধ) নিয়ে আসা যায়, সে জন্য কাজ করতে হবে। সেটা একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। জনগণকে পেসিভ থেকে অ্যাকটিভে রূপান্তর করার যে কাজ, সেটাই এখন বিএনপির করণীয় বলে আমি মনে করি।’

 


মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর