প্রকাশিত:
২০ জানুয়ারী ২০২৪, ১০:৩৭
সারা দেশে গ্যাসের তীব্র সংকটের মধ্যেই এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) টার্মিনালে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এতে হঠাৎ করেই চট্টগ্রামে বাসাবাড়ি ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। শুক্রবার সকালে চুলায় গ্যাস জ্বলতে না দেখে অনেকে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ছুটে যান। কিন্তু বহু রেস্তোরাঁয়ও রান্না হয়নি। ফলে চাহিদার তুলনায় খাবার কম থাকায় অনেককেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। নগরীর বিভিন্ন খাবারের দোকানের সামনে গ্রাহকদের ভিড় দেখা গেছে। অনেক এলাকায় বৈদ্যুতিক চুলা ও লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্নার কাজ সারেন বাসিন্দারা। নগরীর ফিলিং স্টেশনগুলোতেও যানবাহনের দীর্ঘ লাইন লেগে যায়। সেখানেও নেই গ্যাস। এ কারণে সড়কে কমে যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চলাচল।
এদিকে কিছুদিন ধরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। এতে শিল্প উৎপাদনে ধস নামছে। গ্যাস সংকটে গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। শ্রমিকরা কারখানায় আসছেন ঠিকই কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে কাজ করতে পারছেন না। এতে কারখানা মালিকরা পড়েছেন মহাবিপদে। প্রতিদিন তাদের লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের শিল্প-কারখানাগুলোর অবস্থাও একই। দিন দিন এ সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করলেও এর কোনো সুরাহা মিলছে না।
কারখানার মালিকরা বলছেন, বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে ১ থেকে ২ পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। তারা বলেন, একদিকে ডলার ক্রাইসিস অপরদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে এ সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসবে।
গ্যাস সংকটের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ২০২৬ সালের মধ্যে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কাজ চলছে। তবে সম্প্রতি যে সংকট চলছে সেটি কিছুদিনের মধ্যে সমাধান হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে মজুমদার নাজিম উদ্দিন জানান, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে পাওয়া গ্যাস চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করা হয়। একটি এলএনজি টার্মিনালে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিলে ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে টার্মিনালটি চালু করতে গেলে পুনরায় যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সমস্যা দেখা দেওয়া টার্মিনালটির মেরামতের কাজ চলছে। আজ সকাল নাগাদ টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে।
এদিকে চট্টগ্রামের প্রায় সব এলাকায় ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার দিনভর গ্যাসের হাহাকার দেখা দেয়। চুলা জ্বলছে না সকাল থেকে। এতে বাসা-বাড়িতে রান্না-বান্নাও একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। খাবারের জন্য সকাল থেকে অনেককে হোটেলে-রেস্তোরাঁয় ভিড় করতে দেখা যায়। কোনো কোনো হোটেলের সামনে ছিল লম্বা লাইন। হোটেলগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে রান্না করতে হয়েছে। অনেক হোটেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খাবার শেষ হয়ে যায়। তাই খাবারের সন্ধানে কাউকে কাউকে এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে ছুটে বেড়াতে হয়েছে।
শিল্প কারখানা ও সিএনজি স্টেশনেও গ্যাস ছিল না। এতে কারখানায় উৎপাদন ও সিএনজি স্টেশন থেকে গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গ্যাস স্টেশনগুলোতে সকাল থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু গ্যাস মিলছিল না। কোথাও কোথাও স্টেশন ছাড়িয়ে অটোরিকশার লাইন চলে যায় রাস্তা পর্যন্ত। গ্যাসের অভাবে নগরীতে টেম্পো, মিনিবাস, অটোরিকশা ও হিউম্যান হলার চলাচল বন্ধ ছিল। এতে শুক্রবার ছুটির দিনেও নগরীজড়ে দেখা দেয় তীব্র গণপরিবহণ সংকট। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে গাড়ির জন্য শত শত যাত্রীকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বিভিন্ন রুটে ছোট আকারের কিছু গণপরিবহণ চলাচল করতে দেখা যায়, যেগুলো আগের রাতে গ্যাস নিয়ে রেখেছিল। তবে এগুলোতে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় দ্বিগুণ ভাড়া। নাছির উদ্দিন নামে এক যাত্রী জানান, স্টেশনে গ্যাস নেই এই অজুহাতে মুরাদপুর-অক্সিজেন রুটের অটোরিকশা ও হিউম্যান হলারগুলো দ্বিগুণ ভাড়া নিয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। গ্যাসনির্ভর কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেশি সমস্যা হবে রপ্তানিমুখী শিল্পে। কারণ যথাসময়ে অর্ডার অনুযায়ী পণ্য শিপমেন্ট করতে না পারলে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এতে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। তিনি বলেন, ভাসমান এলএনজি টার্মিনালে যেকোনো সময় টেকনিক্যাল সমস্যা হতেই পারে। তবে সে সমস্যা সমাধানের জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। একটি টার্মিনালে সমস্যা হলে বিকল্প হিসাবে যেন অন্য একটি থেকে গ্যাস সরবরাহ করা যায় সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে। অর্থাৎ জ্বালানি সেক্টরে স্মার্ট ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে জনগণকে যেমন দুর্ভোগ পোহাতে হবে তেমনি অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কেজিডিসিএল জেনারেল ম্যানেজার (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) গৌতম কুন্ডু ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। একটি এলএনজি টার্মিনাল চালুর পর টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। এটি মেরামত চলছে। সেখান থেকে আমরা যে তথ্য পাচ্ছি, তাতে আশা করা যায় ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার মধ্যরাত কিংবা শনিবার (আজ) সকালের দিকে মেরামত শেষে টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হতে পারে। এটি চালু হলে আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী গ্যাস পাব।
তিনি জানান, চট্টগ্রামে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ৫০ মিলিয়ন আবাসিক ও ৫০ মিলিয়ন শিল্প কারখানায় সরবরাহ করা হয়। বাকি গ্যাস ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ ও সার কারখানায়।
নগরীর আতুরার ডিপো বনানী আবাসিক এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, তাদের এলাকায় প্রায় দুই মাস ধরে গ্যাস সংকট চলছে। দিনের বেশিরভাগ সময়ই গ্যাস থাকে না। মাঝেমধ্যে অল্প চাপে চুলায় গ্যাস পাওয়া যায়। তখন রান্নার কাজ সেরে রাখতে হয়। তবে ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার ভোর থেকে একেবারেই গ্যাস বন্ধ হয়ে গেছে। তাই হোটেল থেকে সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার এনে খেতে হয়েছে।
এদিকে নিয়মিত লাইনের গ্যাস না পেয়ে অনেকেই গ্যাস সিলিন্ডার কিনছেন। তাই সিলিন্ডারের দোকানে ভিড় বেড়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার ও বৈদ্যুতিক চুলা কেনার হিড়িক পড়েছে বিভিন্ন এলাকায়। হালিশহর শাপলা আবাসিক এলাকার জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার ভাড়াটেদের দুয়েকজন গ্যাস সিলিন্ডার কিনেছেন। যদিও এখানে লাইনের গ্যাস রয়েছে।
তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, গার্মেন্টস শিল্প বিদ্যুৎনির্ভর হলেও কিছু কিছু সেকশন গ্যাসে চলে। যাদের ডায়িং ও ওয়াশিং প্লান্ট রয়েছে, তাদের গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। বেশ কিছু দিন ধরে চাহিদামতো গ্যাস মিলছে না। এতে ডায়িং ও ওয়াশিং প্লান্টগুলো সমস্যায় পড়েছে। পোশাক আয়রন করতেও সমস্যা হচ্ছে। কেউ কেউ গ্যাসের বিকল্প হিসাবে বৈদ্যুতিক জেনারেটর ব্যবহার করছেন। এতে বাড়তি ব্যয় গুনতে হচ্ছে।
মন্তব্য করুন: