প্রকাশিত:
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৮
প্রজাতন্ত্র হিসেবে তুরস্ক এক শ বছর পার করছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে দেশটির ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা বোঝার জন্য ইতিহাস ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা জরুরি। বিশেষ করে পশ্চিমের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কটা বিবেচনা করা জরুরি। কেননা এ সম্পর্ককে উত্তেজনা ও দুই পক্ষের বাস্তব স্বার্থ—দুটি বিষয় দিয়েই চিত্রিত করা যায়।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিজয় আধুনিক তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সম্পর্কের ওপর অনেক ধরনের প্রভাব ফেলবে। এরদোয়ানের নতুন মেয়াদে এই সম্পর্ক নতুনভাবে বিন্যস্ত হবে এবং ভবিষ্যতের গতিপথ ঠিক করে দেবে।
ঐতিহাসিকভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই তুরস্কের জনগণের মনোভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিমা জনমনে চাপান-উতোর চলে আসছে। অটোমান সাম্রাজ্য ক্ষমতা সংহত করলে পশ্চিমে ভয় ও তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্ক নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে এই মনোভাব আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
সাম্প্রতিককালে একের পর এক ঘটনা পশ্চিমের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র) সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি করেছে। ২০০৩ সালে আমেরিকান সেনাদের ইরাক অভিযানে তুরস্ক তাদের ভূমি ব্যবহার করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়। ২০১১ সালে তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আঙ্কারা যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-তুরস্ক জোট ভেঙে দেয়। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিপরীতে দিয়ে সিরিয়া প্রশ্নে নিজেদের পৃথক নীতি গ্রহণ করে।
সময়ের পরিক্রমায় কিছু বিষয় বদলে গেছে। যেমন অর্থনৈতিক স্বার্থে তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ২০২২ সালে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আঙ্কারা সফর করেন।
১৪ বছরের মধ্যে দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলোচনা এটি। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সিরিয়া ইস্যুতে তুরস্কের অবস্থান পশ্চিমের সঙ্গে দেশটির বিবাদ ও অস্বস্তির কারণ হয়েছে। কেননা সিরিয়া প্রশ্নে তুরস্ক রাশিয়া ও ইরানের পথ অনুসরণ করছে। ন্যাটো সদস্য গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের অব্যাহত উত্তেজনাও দেশটির সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে।
তুরস্কের ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে আঙ্কারা। ১৯৯৯ সাল থেকে গুলেন পেনসিলভানিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসনে রয়েছেন। গুলেনের হিজমেত আন্দোলনকে তুরস্ক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যা দেয়। ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান–প্রচেষ্টার জন্য গুলেনকে দায়ী করে তাঁকে তুরস্কের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে আঙ্কারা। কিন্তু সেই আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় দুই দেশের উত্তেজনার পারদ আরও চড়েছে।
গত কয়েক বছরে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমের আরও কিছু বিষয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে করে তুরস্কে তেল ও গ্যাস সরবরাহ, তুরস্কের কাছে রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ অন্য অস্ত্র বিক্রি, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে রাশিয়ার কারিগরি সহায়তা এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধি। এ ছাড়া ন্যাটোর মধ্যে তুরস্ক একমাত্র দেশ, যারা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়ার জ্বালানি চীন ও ইরানে পরিবহনে করেছে তুরস্ক।
তুরস্কের যে অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান, সেটাকে ব্যবহার করে দেশটি ন্যাটোতে প্রাচ্য ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। ন্যাটোতে ফিনল্যান্ডের যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তুরস্ক মূল ভূমিকা পালন করেছে। সুইডেনের ক্ষেত্রেও প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও ওয়াশিংটনের দিক থেকে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার প্রস্তাবে সেই আপত্তি তুলে নেয় তারা।
সুইডেনকে ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি দিলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। এ বিষয়টি পশ্চিমের সঙ্গে তুরস্কের উত্তেজনা জিইয়ে থাকার বড় কারণ। দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি, প্রাচুর্যময় প্রাকৃতিক সম্পদ, অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান—এসব কারণে তুরস্ক একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীনের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তুরস্কের সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে যে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতার ধস নেমেছে—এমন ধারণা ছিল ভুল। খুব কম ব্যবধানে জিতলেও এরদোয়ান আগামী কয়েক বছরের জন্য তাঁর শাসন নিশ্চিত করেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে এবং ন্যাটোতে দেওয়া নিজের প্রতিশ্রুতি পূরণে জোর দিয়ে এরদোয়ান খুব সফলতার সঙ্গে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।
মন্তব্য করুন: