প্রকাশিত:
২৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:২৩
৬৯ সালে সুয়েজ খাল চালু হওয়ার আগে লোহিত সাগর দিয়ে যেসব জাহাজ চলত, সেগুলো মূলত মসলা, কফি ও দাস পরিবহন করত। এই খাল চালু হওয়ার পর লোহিত সাগরের দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে যায়। ২০২৩ সালের এ পর্যন্ত এই সাগর দিয়ে ২৪ হাজার জাহাজ চলেছে, পরিমাণের দিক থেকে তা বৈশ্বিক সমুদ্রপথে পরিচালিত বাণিজ্যের ১০ শতাংশ। জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান ক্লার্কসন্সের তথ্যানুসারে, এ বছর বিশ্বে কনটেইনার পরিবহনের ২০ শতাংশ এই পথ দিয়ে হয়েছে। এ ছাড়া সমুদ্রপথে পরিবাহিত তেলের ১০ শতাংশ আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের ৮ শতাংশ লোহিত সাগরপথে পরিবহন হয়েছে।
বিষয়টি হলো, লোহিত সাগর ও অডেন উপসাগরকে যুক্ত করা বাব এল-মান্দেব প্রণালিতে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা যে হামলা চালাচ্ছেন, তা জাহাজশিল্প ও গ্রাহকদের জন্য নতুন করে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। উভয় পক্ষই এখন মহামারি ও সাম্প্রতিক খরার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় আছে। ফলে হুতিদের এই তৎপরতায় উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, গাজার ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে হুতি বিদ্রোহীরা এই হামলা চালাচ্ছেন। কিন্তু এবারের সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলেও জাহাজভাড়া খুব বেশি বাড়বে না এবং বিশ্ববাণিজ্য তেমন একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর দ্য ইকোনমিস্টের
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে হুতি বিদ্রোহীদের ডজনখানেক হামলা ও সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর তাঁদের আরও চারটি হামলা জাহাজ পরিবহনের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত কনটেইনারবাহী বড় বড় জাহাজে পণ্য পরিবহন করা হয়, কিন্তু এই হামলার পর সুইজারল্যান্ডের এমএসসি ও ডেনমার্কের মেয়ার্সকের মতো কনটেইনারবাহী জাহাজ কোম্পানি লোহিত সাগরপথে জাহাজ পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ও ইকুইনার মতো কয়েকটি জ্বালানি কোম্পানিও সাময়িকভাবে সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন বন্ধ রেখেছে। এর আগে ২০২১ সালে কনটেইনারবাহী বিশাল জাহাজ এভার গিভেন সুয়েজ খালে আটকে যাওয়ায় জাহাজ পরিবহন ছয় দিনের জন্য বন্ধ ছিল, তখন অবশ্য জাহাজ কোম্পানিগুলো আফ্রিকা ঘুরে জাহাজ চালিয়েছে। ক্লার্কসন্স জানিয়েছে, সে কারণে এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপের যাত্রার সময় ৯ দিন বেড়েছে। এখন এই পথ যাত্রার জন্য নিরাপদ না হলে জাহাজগুলোর সময়সূচি পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং তাতে বন্দরগুলোয় জট লেগে যাবে।
তারপরও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সুয়েজ খালের এই সংকটের কারণে বিশ্ববাণিজ্য থেমে যাবে না। তাঁদের এই আশাবাদের কারণ হলো, জাহাজশিল্পের উত্থান-পতন স্বাভাবিক বিষয়। এভার গিভেনের সময় যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, এখন সংকট অতটা তীব্র নয়। সেই সময় অনেক দেশেই লকডাউন চলছিল, ফলে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় জাহাজের পরিবহন ব্যয় আকাশ ছুঁয়ে যায়। জাহাজের স্পট ভাড়া ২০ হাজার ডলার ছাড়ায়। জন ম্যাককাউনন কনটেইনারের রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের জাহাজশিল্পের মুনাফা ২১৫ বিলিয়ন বা ২১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে উঠে যায়, অথচ ২০১৬ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত এই শিল্পের সম্মিলিত ক্ষতি হয়েছে ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৮৫০ কোটি ডলার।
জাহাজশিল্পের মুনাফা বেড়ে যাওয়ায় অনিবার্যভাবে তারা নতুন নতুন জাহাজের কার্যাদেশ দিয়েছে। সেই সব নতুন জাহাজ এখন সাগরে নামতে শুরু করেছে, যদিও গত দুই বছরে চাহিদা বাড়েনি। আইএনজি ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক জাহাজ পরিবহনের সক্ষমতা ৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ১১ শতাংশ বাড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৩ সালে জাহাজশিল্পের মুনাফা ৮০ শতাংশ কমবে।
বাস্তবতা হলো, জাহাজশিল্পের সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এখন পরিবহনের সময় বেড়ে গেলেও খুব একটা সমস্যা হবে না; ২০২০ সালের কোভিডের সময় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এখন তেমনটা হবে না। ডিসেম্বর মাসে জাহাজভাড়া এমনিতেই অনেকটা কমে এসেছে। লোহিত সাগরের এই গোলযোগের কারণে জাহাজভাড়া দ্বিগুণ হতে পারে, তা ঠিক, কিন্তু জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান জেনেটার পিটার স্যান্ড মনে করেন, মহামারির সময় জাহাজভাড়া যে পর্যায়ে উঠেছিল, এখন তার চেয়ে অনেক নিচেই থাকবে। ফলে জাহাজ কোম্পানিগুলোর মুনাফাও কমবে।
মন্তব্য করুন: