প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২৩, ২১:২৩
বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের আঞ্চলিক বৈষম্য এখনও দৃশ্যমান আছে। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট), উত্তর পূর্বাঞ্চল (নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ) মধ্য দক্ষিণাঞ্চল (মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, রাজবাড়ী) এলাকায় উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ মধ্যাঞ্চল তথা ঢাকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা চট্টগ্রাম অঞ্চলের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে কম। ফলে এসব অঞ্চলের অনেক এলাকাতেই দারিদ্র্যের হারও তুলনামূলকভাবে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন অঞ্চল যেমন পটুয়াখালী, খুলনা, কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকায় অবকাঠামো, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে, যা এসব এলাকার আঞ্চলিক উন্নয়নকে বেগবান করবে।
তদুপরি উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের স্থানিক ও আঞ্চলিক বিবেচনাসমূহ আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল স্রোতধারায় বিবেচিত না হওয়াতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এর মধ্যে ভারসাম্যহীন অবস্থা এখনও বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সমগ্র দেশের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটের বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। অদ্য শনিবার, ১৭জুন, আইপিডি সম্পাদিত 'বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের আঞ্চলিক বিন্যাস' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উপরোক্ত বিষয়গুলো উঠে আসে। আইপিডি'র পক্ষ থেকে গবেষণাটি করেন পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান ও সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
উক্ত গবেষণাটিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটের সাধারণ সরকারি সেবা, প্রতিরক্ষা এবং জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাত ব্যতীত বাকি ১২ টি খাতের চলমান প্রকল্পের বাজেটসমূহের জেলা ও আঞ্চলিক অবস্থান বিবেচনা নিয়ে স্থানিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যাতে এডিপির প্রায় ৭০ ভাগ প্রকল্পকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তবে এই গবেষণায় জাতীয় প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে দেশের জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্প রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা বহুমুখী সেতু, পদ্মা রেলসেতু ও যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু রেল সেতুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
গবেষণা প্রতিবেদন এর মূল উপস্থাপনায় অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, দেশের এডিপি প্রকল্পে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ৭ টি জেলাই মোট বরাদ্দের ৫০ ভাগ বরাদ্দ পাচ্ছে, অথচ স্বল্প বরাদ্দপ্রাপ্ত ২৫ টি জেলা পাচ্ছে মাত্র ১৩ ভাগ। বৈষম্য পরিমাপক 'পালমা রেশিও' অনুযায়ী যার মান ৩.৭২, যা এখন ও দেশের মধ্যে উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের উচ্চ বৈষম্যকেই নির্দেশ করে। ঢাকা জেলা উন্নয়ন বরাদ্দের ২১ ভাগ পাচ্ছে, তবে বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্প চলমান থাকায় দ্বিতীয় স্থানে আছে কক্সবাজার (শতকরা ৯ ভাগ)। তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে চট্টগ্রাম (৬.৮৫ ভাগ) ও নারায়ণগঞ্জ (৩.৮৫ ভাগ)। বরাদ্দপ্রাপ্তির দিক থেকে সবচেয়ে কম পাচ্ছে মেহেরপুর জেলা (০.৩৬ ভাগ) ও পঞ্চগড় (০.৩৯ ভাগ)। এর উপরেই আছে চুযাডাংগা ( শতকরা ০.৪১), ঠাকুরগাঁও (০.৪৩), ঝালকাঠি (০.৪৫), ঝিনাইদহ (০.৪৮), বরগুনা (০.৪৮) ও জয়পুরহাট (০.৪৮ ভাগ)।
আঞ্চলিক বিবেচনায় বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল (পুরাতন বৃহৎ জেলা) পাচ্ছেশতকরা ৩২ ভাগ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল পাচ্ছে ১৫ ভাগ। বিপরীতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ পাচ্ছে বৃহত্তর কুষ্টিয়া (১.৫৩ ভাগ), পার্বত্য অঞ্চল (১.৬০), বৃহত্তর বগুড়া (১.৬৮) ও বৃহত্তর দিনাজপুর (১.৮০ ভাগ)। ফলে দেশের জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে দেশের পদ্মা সেতু চালু হবার পাশাপাশি বিভিন্ন অবকাঠামো ও উন্নয়ন উদ্যোগের কারণে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়ন বৈষম্য কমবার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আইপিডির উপদেষ্টা অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত এলাকা তথা পাহাড়ি অঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল, হাওর এলাকা ও চরাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। কুডিগ্রামের চর রাজিবপুর এলাকার দারিদ্র্যের হার স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কেন ৭৯ শতাংশ, সেই বিশ্লেষণ করে এই ধরনের এলাকাসমূহের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ ও টেকসই অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
উন্নয়ন গবেষক রেদওয়ানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সরকারি -বেসরকারি উদ্যোগে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, যা প্রশংসনীয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও অধিকাংশ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে হচ্ছে, যা সরকারের উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, আঞ্চলিকভাবে দেশের সুষম উন্নয়ন করতে হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের স্থানিক ম্যাপিং করবার মাধ্যমে প্রকল্প ও উন্নয়ন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। চীন ও জাপানের মত দেশ এভাবেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আঞ্চলিক বৈষম্য কমাতে সক্ষম হয়েছে।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফউদ্দিন ফাহিম বলেন, পাবনা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ব্যক্তি উদ্যোগে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে উঠলেও বেসরকারি বড় আকারের বিনিয়োগ এখানে অনুপস্থিত।
কোওপারেটিভ জোনাল ইন্সটিটিউটের কর্মকর্তা মো. সালিমুল আলম বলেন, আমাদের দেশে গ্রামীণ পর্যায়ে দারিদ্র্য কমানো ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প চলমান থাকা সত্ত্বেও কেন উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্য কমানো যাচ্ছে না, সেটার তত্ত্বানুসন্ধান করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে সুনির্দিষ্ট প্রাধিকার দিয়ে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন: