প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২৩, ১৩:১৭
কিছুদিন আগের ঘটনা। একজন কিডনি রোগীকে দ্রুত রক্ত দিতে হবে। রোগীর আত্মীয়স্বজন রক্ত খুঁজছেন। তখন জরুরিভাবে রক্ত সরবরাহ করতে পারে, এমন একটি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ওই রোগীর এক স্বজন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান রোগীর কাছে ছুটে যান এবং তাঁকে রক্ত দেন। এতে রোগীর স্বজনেরা স্বস্তি পান। রক্ত দেওয়ার পর রক্তদাতাকে ধন্যবাদ জানান রোগীর স্বজনেরা।
জরুরি মুহূর্তে রোগীদের জন্য রক্ত সরবরাহকারী এই মানবদরদি সংগঠনের নাম ব্লাড ডোনেট ক্লাব। ওই দিন যে রোগীকে রক্ত সরবরাহ করা হয়েছিল, সেই রোগীর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখার হরিনগরে। তাঁর নাম সমছ উদ্দিন (৮০)। ব্লাড ডোনেট ক্লাবও বড়লেখারই। তবে ক্লাবটির কার্যক্রম এখন বড়লেখাসহ কুলাউড়া, জুড়ী ও সিলেটের বিয়ানীবাজারেও বিস্তৃত। ২০১৪ সাল থেকে ক্লাবের সদস্যরা রোগীদের রক্ত দিচ্ছেন। ডাক পেলেই রোগীর কাছে ছুটে যাচ্ছেন ক্লাবটির কেউ না কেউ। এ পর্যন্ত এই ক্লাবের সদস্যেরা পাঁচ হাজার রোগীকে রক্ত সরবরাহ করেছেন বলে জানান ক্লাবের স্থায়ী পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম।
বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের উদ্যোক্তা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন বড়লেখায় ব্লাড ডোনেট ক্লাবের যাত্রা শুরু। শুরুটা হয়েছিল ব্লাড ডোনেট ক্লাবের স্থায়ী পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবলুর উদ্যোগে। ২০১০ সালে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার তাঁর (নুরুল ইসলাম) এক বন্ধুর বোনকে রক্তদানের মধ্য দিয়ে এই ক্লাব চালু করার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সেই সময় (২০১০) বন্ধুর সঙ্গে রোগী নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন তিনি। ওই রোগীর রক্তের দরকার। কোথায় রক্ত পাবেন। তাঁর রক্তের গ্রুপও জানা নেই। তখনই ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উৎসাহে তাঁর রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা হলো। রোগীর সঙ্গে গ্রুপ মিলে যায়। সেই প্রথম রক্ত দিলেন তিনি। এরপর প্রয়োজন হলেই পরিচিত-অপরিচিত রোগীকে রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু রক্তের চাহিদা অনেক। অনেক মানুষ রক্ত চান। কিন্তু রক্তদাতা তত নেই। একজন চার মাসে একবার রক্ত দিতে পারেন। তখনই একটি সংগঠন করার ভাবনা আসে। এ নিয়ে ঘনিষ্ঠজন বদরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান শামীম, মিছবাহ উদ্দিন, আছলাম হোসাইন, কামরুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলামের সঙ্গে আলাপ করেন। সবাই সাড়া দিলেন, সংগঠন হলো। এখনো এই সাতজনই সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত আছেন।
সংগঠনের সাত উদ্যোক্তার মধ্যে শুধু কামরুল ইসলাম প্রবাসে, তবে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যাঁদের নিয়মিত রক্তদানের ইচ্ছা আছে, মনমানসিকতা আছে, তাঁদের সদস্য করা হয়েছে। রক্তদাতার তথ্যকার্ড করা হয়েছে।
ওই কার্ডে ২০ বার পর্যন্ত একজন রক্তদাতার তথ্য লিখে রাখার ব্যবস্থা আছে। তবে এমন ব্যবস্থা থাকলেও সব রক্তদাতার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বড়লেখা উপজেলাতেই প্রায় তিন হাজার সদস্য আছেন। জুড়ী, কুলাউড়া ও বিয়ানীবাজারে আছেন আরও প্রায় এক হাজার। ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি এবং ১৯ সদস্যবিশিষ্ট স্থায়ী কমিটি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাঁদের সদস্যের মধ্যে বেশির ভাগই রক্তদাতা।
এর বাইরে বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের পক্ষ থেকে মানুষকে সচেতন করতে নিয়মিত প্রচারাভিযান চালানো হয়, প্রচারপত্র বিলি করা হয়; ফেস্টুন, স্টিকার লাগানো হয়। এসবে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোন নম্বর দেওয়া থাকে। কেউ যোগাযোগ করলে সাংগঠনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রক্তের গ্রুপ, এলাকা উল্লেখ করে পোস্ট দেওয়া হয়। যে রক্তদাতা সেই এলাকার পাশাপাশি থাকেন, তিনি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে উপস্থিত হন। রোগী দেখে তারপর রক্ত দেন।
ক্লাবের স্থায়ী পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম গত বুধবার বলেন, ‘নিজেদের কাজের ফাঁকে আমরা রক্তদানের কাজ করি। কিন্তু প্রতিদিনই কেউ না কেউ বিভিন্ন স্থানে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনকে রক্ত দিচ্ছেন। সব হিসাব রাখা সম্ভব হয় না। রক্ত দেওয়ার পর অনেক ছবি আমাদের পেজে পোস্ট করি। এ পর্যন্ত ব্লাড ডোনেট ক্লাব থেকে আনুমানিক পাঁচ হাজার মানুষকে রক্ত দেওয়া হয়েছে।’
বড়লেখার তারাদরম গ্রামের ছায়রা বেগম জানিয়েছেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকেরা রাতের মধ্যে দ্রুত কয়েক ব্যাগ রক্ত জোগাড়ের কথা বলেন। নাহলে মেয়েকে বাঁচানো কঠিন হবে। তাৎক্ষণিক বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা তিন ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে। এ রকম অনেক রক্তগ্রহীতা, তাঁদের পরিবারের সদস্য ব্লাড ডোনেট ক্লাবের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতা, ঋণের কথা বলেছেন।
মন্তব্য করুন: