প্রকাশিত:
১০ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৩৪
বিশ্ব ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারণা বদলে দিয়েছিল রেলের আবিষ্কার। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জর্জ স্টিফেনসন ১৮২৫ সালে ব্রিটেনে রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন।
এর মাত্র সাত বছর পরেই ভারতবর্ষের মাদ্রাজে ১৮৩২ সালে রেলপথ চালু হয়। আর বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ব্রিটিশদের হাত ধরে রেলপথ চালু হয় ১৮৬১ সালে। দর্শনা-জগতি রুটের মাধ্যমে চালু রেলপথ ব্রিটিশদের হাত ধরে পরবর্তী ৯০ বছরেই বাংলার অধিকাংশ জেলাতেই পৌঁছে যায়।
কিন্তু এরপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর রেল যোগাযোগের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ ছোট-বড় শতাধিক রেলসেতু ধ্বংসের মুখে পড়ে।
দেশ স্বাধীনের পরে অতিদ্রুতই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু করেন বঙ্গবন্ধু।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে থমকে যায় বাংলাদেশের রেলওয়ের উন্নয়ন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে বন্ধ করা হয় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও রেলওয়ে খাতে বিনিয়োগ।
১৯৭৫ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া-এরশাদ শাসনামলে নতুন কোনো রেলপথ নির্মিত হয়নি। আর লোকসান দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় একের পর এক রেলপথ।
আর ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’-এর নামে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। এ ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাবে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক স্টেশন।
এরপর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তারপর ডুবতে বসা রেলওয়েকে উদ্ধারে একাধিক পদক্ষেপ নেন। নির্মাণকাজ চলমান থাকা যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে সড়ক পথের সঙ্গে যুক্ত করেন রেলপথও।
একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন থেকে জয়দেবপুর জংশন পর্যন্ত ৯৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থেকে জামতৈল হয়ে নতুন ঈশ্বরদী বাইপাস বানিয়ে পার্বতীপুর পর্যন্ত ব্রডগেজ অংশকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করার উদ্যোগ নেন শেখ হাসিনা।
সে সময় শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া যুগান্তকারী এ প্রকল্পগুলোর ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ে বেঁচে যায় বিলুপ্তির হাত থেকে।
এ প্রসঙ্গে গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক স্বৈরশাসকরা এ দেশের কোনো মঙ্গল বা উন্নতি চায়নি। যার কারণে সাধারণ মানুষের যাত্রী পরিবহনের যে কয়টা মাধ্যম ছিল, একে একে তা সবই ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এমনকি রেল লাভজনক নয়, এ অজুহাত তুলে রেলকেও বন্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। রেলের লোকবল গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে বিদায় করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, অনেক রেললাইনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, তখনই এটা করা হয়। ’
২০৩০ সালে রেলে নব দিগন্ত
রেল সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গত ১৪ বছরে সারাদেশের নতুন রেলপথ নির্মাণ করেছে ৭৪০ কিলোমিটার। আর সিঙ্গেলগেজ রেলপথ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করা হয়েছে আরও ২৮০ কিলোমিটার।
অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ক্ষয়প্রাপ্ত রেলপথ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩০৮ কিলোমিটার। আর নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ১২৬টি ও ২২৩টি স্টেশন ভবন পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
গত ১৪ বছরে নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে ৭৩২টি আর রেলসেতু পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ৭৭৪টি।
পরিবর্তন এসেছে যাত্রী পরিবহন সক্ষমতায়ও। ট্রেনে গত ১৪ বছরে লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) যুক্ত হয়েছে ১১১টি।
অন্যদিকে যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হয়েছে ৫৮৮টি। নতুন করে ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হবে ৪৬০টি আর মিটারগেজ যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হবে ১৫০টি। আরও ৪৬টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ যুক্ত হবে।
পণ্য বহনের জন্য ওয়াগন যুক্ত হয়েছে ৫১৬টি। আর নতুন ওয়াগন যুক্ত হবে ১ হাজার ৩১০টি। আধুনিক লাগেজ ভ্যান যুক্ত হবে ১২৫টি।
শেখ হাসিনা সরকারের সময় বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালু করেছে ৭২৩টি।
এর আগে ২০৩০ সালের মধ্যে ভিন্ন রেল যোগাযোগের সাক্ষী হবে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সরকার নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করছে। এতে সারাদেশে রেল যোগাযোগের দারুণ নেটওয়ার্ক তৈরি হচ্ছে। রেলখাতে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় নব দিগন্তের সূচনা হবে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে রেলওয়ের পরিষেবায়। ’
রেলের বাজেট বাড়াতে পৃথক মন্ত্রণালয় করেন শেখ হাসিনা
রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলে বরাদ্দের ৯০ শতাংশই পেত সড়ক বিভাগ। আর যে ১০ শতাংশ রেল পেত তা চলে যেত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধে। ফলে রেলওয়ে নিতে পারত না নতুন কোনো রেলপথ নির্মাণ সংস্কারের উদ্যোগ।
এরপর ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেলওয়েতে নতুন কোনো নিয়োগ ছিল না এবং এটাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের দেশে যোগাযোগব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ছিল রেল। রেলকে বেসরকারিকরণের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল।
এরপর গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একের পর এক মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের নব দিগন্তের সূচনা হয় বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
৬৪ জেলায় রেলপথ নিতে মহাপরিকল্পনা
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে এতদিন ৪৩টি জেলায় রেলপথ চালু ছিল। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের উদ্বোধনের মাধ্যমে আরও তিন জেলা যুক্ত হলো দেশের রেল নেটওয়ার্কে। এ তিন জেলা হলো- মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর।
আর ২০২৪ সালে পদ্মা রেল সংযোগের পুরো প্রকল্পের উদ্বোধন হলে যুক্ত হবে নড়াইল। আর মধুখালী-মাগুরা রেলপথের উদ্বোধন হলে নতুন করে যুক্ত হবে মাগুরা জেলা।
নভেম্বর মাসের উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের আরও দুই প্রকল্প। খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্প ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্প।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের মাধ্যমে পর্যটন নগরী কক্সবাজার রেল সংযোগের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হবে আগামী ১২ নভেম্বর। এর মধ্য দিয়েই কক্সবাজার জেলাও যুক্ত হবে দেশের রেল নেটওয়ার্কে।
অন্যদিকে আগামী ৯ নভেম্বর ৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকায় মোংলা-খুলনা রেল প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে রেল সংযোগে যুক্ত হচ্ছে বাগেরহাট জেলা। ৬৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণের মাধ্যমে রেল করিডোরে যুক্ত হচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা।
তারপর ধীরে ধীরে রেলওয়ের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্ত হবে বাবি জেলাসমূহ। এসব জেলাকে রেলপথে সংযুক্ত করতে বিভিন্ন প্রকল্পের সমীক্ষার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এর মধ্যে প্রথম ধাপে যুক্ত হবে সাতক্ষীরা, বরিশাল, রাঙামাটি, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মেহেরপুর রেলপথের আওতায় আসবে।
আর ২০৪৫ সালের মধ্যে সর্বশেষ ধাপে লক্ষ্মীপুর, শেরপুর, মানিকগঞ্জ, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলা রেল সংযোগে যুক্ত হবে।
রেলকে প্রত্যেকটি জেলার সঙ্গে সম্প্রসারিত করা হবে বলে জানিয়ে নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমরা আমাদের রেলকে প্রত্যেকটি জেলার সঙ্গে সম্প্রসারিত করব। আমাদের পোর্টগুলোতে (বন্দরগুলো) সম্প্রসারিত করব। আমাদের রেলগুলোকে ইলেকট্রনিক ট্রেকশালে রূপান্তরিত করব। আমাদের যে সিঙ্গেল লাইন আছে সেগুলো ধীরে ধীরে ডাবল লাইনে রূপান্তর করব। ’
মন্তব্য করুন: